একজন লড়াকু মানুষের বিদায়
দেশের এখন সবচেয়ে বড় সংকট অনুসরণ করার মতো কোনো চরিত্র নেই। মানুষ কার কাছে শিখবে, কার কাছে যাবে, কোথা থেকে পাবে সাহস? চারিদিকে চালাক মানুষের ভিড়ে কোথায় পাবে সরল মানুষ যার কাছে দুঃখের কথা বলা যায়। ক্যারিয়ারের কথা বলছে সবাই, চরিত্র তৈরি করার কথা তো বলছে না কেউ। নিজেকে বড় ভাবার মানুষের অভাব নেই কিন্তু নিজেকে বড় করে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত আছেন তেমন মানুষ কই? লক্ষ্যে অবিচল থেকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সাধ্যমতো সব করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই লক্ষ্য বিচ্যুত হওয়া যায় না- এমন দৃষ্টান্ত কোথাও তো দেখি না।
কারো কাছে বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। ক্রমাগত বাড়ে কিন্তু কাবু করে ফেলে না, উদ্যমকে লাগাম পরাতে দেয় না, কৌতূহলকে অবদমন করেন না বরং কৌতূহলের বাতাসে পাল উড়িয়ে দেন, সবসময় থাকেন আগ্রহী ও উদ্যোগী। কেউ আবার বয়সজনিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান বর্তমানের সমস্যা সমাধানে। তার তো বয়স নিয়ে ভাবনার সময়ই থাকে না। একজন সেরকম আমৃত্যু যুবক ছিলেন আমাদেরই মাঝে। যিনি তার ৮১ বছর বয়সকে থোরাইকেয়ার করে ১৮ বছরে নামিয়ে এনেছিলেন। ছুটেছেন অবিরাম। কিন্তু আমরা কি তার যৌবনের শক্তিকে মূল্যায়ন করেছি?
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? জানতে চাইলে নির্দ্বিধায় প্রায় সবাই বলে উঠবেন, কী আবার? ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। কারণ শেখানো হয়েছে, লেখা পড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। অথবা বাবা- মা উদ্বেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেন, ভালো করে পড়াশুনা কর, তা না হলে খাবি কী করে? আর এদেশে থেকে কোনো লাভ নেই, বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সেই লক্ষ্যে চলতে থাকে বিদেশে পড়াশুনা এবং শিক্ষাজীবন শেষে সেখানেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা। এর বিকল্প যারা ভাবেন তাদের বাস্তব জ্ঞানের বিষয়ে সকলেই প্রশ্ন তুলবেন। একবাক্যে বলেন যে, তারা হয় বোকা অথবা তাদের যোগ্যতা নেই। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, বিলাসী জীবনযাপনের মতো আয় রোজগার আছে, বিস্তর সামাজিক যোগাযোগ আছে তার পরও ফিরে এসেছেন দেশের মাটিতে এমন মানুষকে কী বলা যায়?
বাইরে থেকে দেখলে তার জীবন বিতর্কপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, বৈচিত্র্যময় ও বর্ণিল। জীবনের প্রতিটি বাঁক ফেরানোর মুখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের কথা ভেবে নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকেএমবিবিএস পাস করে লন্ডনে গিয়েছিলেন এফআরসিএস পড়তে। তখন তার জীবনযাপন ছিল শখ ও বিলাসিতায় পূর্ণ। তিনি প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স পেয়েছিলেন, যুবকদের আকাঙ্ক্ষিত দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পরতেন। ৪ বছরের এফআরসিএস কোর্স তখন শেষের দিকে। প্রাইমারি পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন, আর কয়েকদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তার মনে কি এই প্রশ্ন আসেনি যে কী করবেন তিনি তখন? উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর অনিশ্চিত জীবনের টানাপোড়েন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সংগ্রামের অনিশ্চিত অথচ মহত্তম পথটাই বেছে নেবেন। ক্যারিয়ারের পরীক্ষা নয় দেশপ্রেমের পরীক্ষায় অংশ নিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে নেমে পড়লেন লন্ডনের রাস্তায়।
লন্ডনের হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এরকম একটি সমাবেশে প্রকাশ্যে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন। পরে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এই যে পাসপোর্ট ছিঁড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব বর্জন করলেন, সিদ্ধান্তটা কী তিনি হঠাৎ করে, না চিন্তা-ভাবনা করে নিয়েছিলেন? হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, 'পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলা ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। তোমরা আমাদের হত্যা করছ, আমি তোমার পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললাম, নাগরিকত্ব বর্জন করলাম।'
তো পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন এরপর কাজ কী? আপাত নিরাপদ বিদেশে থেকে স্বাধীনতার জন্য সহায়তা করা নাকি সংগ্রামে অংশ নেওয়া? তিনি বেছে নিলেন সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ।
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষে তিনি পৌঁছালেন আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন একটি হাসপাতাল। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল এই হাসপাতাল যার নাম দেওয়া হয়েছিল 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল'। ভবন তৈরির অপেক্ষা না করে ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করাহয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল আর এর অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে। প্রশিক্ষিত নার্স নেই তো কী হয়েছে হাতের কাছে তো আগ্রহী মানুষ আছে? ফলে প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। মুক্তিযুদ্ধে এই ফিল্ড হাসপাতালের ভূমিকা অপরিসীম। এই হাসপাতালটিই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে।
স্বাধীনতার পর তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ওষুধ নীতি প্রণয়ন। দেশের ওষুধের বাজার প্রায় পুরোটাই ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ ছিল বাজারে। দেশে কারখানা তৈরি করে উৎপাদন করা হতো আর অধিকাংশই কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করত। ফলে ওষুধের দাম ছিল বেশি আর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চলে যেত দেশের বাইরে। গণমানুষের জন্য চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির কথা নীতি নির্ধারক মহলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তিনি। অবশেষে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। এর ফলে সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। আজ দেশীয় পুঁজিপতিদের মালিকানায় ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা সেই ওষুধ নীতিরই সুফল। এখন মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ এখন ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ।
যখন কোভিড মহামারির আতঙ্ক, তখন তিনি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই হয়েছিল তার চিকিৎসা। 'যে হাসপাতাল তৈরি করলাম, সেখানে যদি নিজে আস্থা না রাখি, সাধারণ মানুষ আস্থা রাখবেন না' এটাই ছিল তার যুক্তি। আবার করোনা চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার যুক্তি ছিল, 'প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।' অনুরোধ করেও কোনো ডাক্তার তার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারেননি।
আবার যখন তার কিডনি রোগ যখন ধরা পড়ল, তার আমেরিকান ডাক্তার বন্ধুরা তাকে আমেরিকায় নিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি কারণ বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট আইন পরিবর্তনের জন্য তিনি আন্দোলন করছিলেন। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাছের আত্মীয় ছাড়া কেউ কিডনি দান করতে পারেন না। এতে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। 'দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। বরং ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।'
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আপনার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্পদের পরিমাণ কত? 'হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার', তার নির্বিকার উত্তর। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এত টাকার সম্পদ, আপনার কখনো মনে হয় না এখান থেকে নিজের কিছু পাওয়ার ছিল? 'না, না আমি টাকা-সম্পদ দিয়ে কী করব। দেশের মানুষের জন্যে আরও অনেক কিছু করার ছিল।' এই ছিল তার উত্তর। তার আরও স্বপ্ন ছিল, চিকিৎসা বাণিজ্য বন্ধ করার, একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক দেশের, সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের এবং সেই স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে তার আমৃত্যু লড়াই ছিল। তিনি কি বামপন্থী ছিলেন? না। তিনি কি প্রথাগত অর্থে ডানপন্থী ছিলেন? তাও নয়। ফলে রাজনৈতিক নানা প্রশ্নে তার সঙ্গে অনেক দ্বিমত থাকলেও মানুষের প্রতি তার দায়বোধ নিয়ে বিতর্ক করবেন না কেউ।
তার জীবন আমাদের শেখায়, জিততে চাইলে মানুষ নাও জিততে পারে কিন্তু কোনো মানুষ যদি প্রতিজ্ঞা করে তিনি হারবেন না তাহলে তাকে হারানো সম্ভব না কিছুতেই। সে রকম মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু হার মানে না কিছুতেই। আমাদের তেমনি একজন হার না মানা যোদ্ধা ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
রাজেকুজ্জামান রতন: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
এসএন