রূপসী ধাইরা ফুল
ছেলেবেলায় নানার বাড়িতে বিশাল এক শিমুল গাছের নিচে পুরনো একটি আমগাছে দেখেছি প্রথম। তখন অবশ্য দেখা পর্যন্তই, জন্মরহস্য নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি। শীতকালে গাছটির ডালপালা জড়িয়ে লালচে রঙের ফুলগুলো ঝুলে থাকত। তখন বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, আমফুল কি দেখতে এমন? বাসি ফুলগুলো ঝরে পড়ত গাছতলায়। আমরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে খেলতে বসতাম। ছোটবেলার সেই ফুলটি আবার নতুন করে যেন ফিরে পেলাম। ঢাকায় রমনা পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুরনো কিছু গাছে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই বেঁচে আছে ওরা। শুধু পার্ক কিংবা উদ্যানেই নয়, পরজীবী এ গাছ প্রায় সারা দেশেই পাওয়া যায়।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায় দেখা ফুলগুলো সবচেয়ে সুদর্শন মনে হয়েছে। তবে পুরনো গাছগুলোর সুউচ্চ ডাল ওদের প্রিয় আবাস হওয়ায় একটু ভালোভাবে খুঁজলেই কেবল দেখা মিলবে। এ কারণে ভালোভাবে না তাকালে সচরাচর চোখে পড়ে না। মূল গাছের দিকে তাকালে মনে হবে একগুচ্ছ জীবন্ত লতাপাতা যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে!
এরা পরজীবী গাছ। সাধারণত ধাইরা (Dendrophthoe falcata) নামেই বেশি পরিচিত। কোথাও কোথাও মান্দা বা বান্ধা নামেও ডাকে। প্রিয় আবাস পরিণত আম গাছ। কখনো কখনো মেঘশিরীষ, মেহগনি, রাবারবট বা কাঁঠাল গাছেও দেখা যায়। বাংলার বনফুল গ্রন্থে নওয়াজেশ আহমদ জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম বাগানগুলোতে এদের বেশি দেখা যায়। নেপালের হিমালয় অঞ্চলে আরেকটি প্রজাতি বেশ সহজলভ্য।
প্রকৃতিতে শীতের আবহ শুরু হলেই এদের উজ্জ্বল রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। বছরের বাদ-বাকি সময় আমাদের চোখেই পড়ে না। কাষ্ঠল লতা। গুচ্ছমূল আশ্রয় আঁকড়ে থাকে। পাতা পুরু ও বিপ্রতীপভাবে বিন্যস্ত। প্রস্ফুটনকাল ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। ফুল গুচ্ছবদ্ধ, পুষ্পনল উজ্জ্বল লাল, ওপরে মুখের কাছে সবুজ, চারটি দীর্ঘ আয়তাকার লতিযুক্ত, আড়াই থেকে সাড়ে তিন সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, বৃতি খাটো, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত পাপড়ি চুলের মতো সরু ও মরিচা রঙের।
সহজলভ্য আরেকটি ভ্যারাইটির পুষ্পনল সাদাটে। বংশবৃদ্ধি পাখিদের মাধ্যমেই। পাখিরা ফল খেয়ে যেসব গাছে ঠোঁট ছোঁয়ায় সেখানেই বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এ গাছের আগ্রাসন মূল গাছকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে বাকল ও পাতা বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। সারা পৃথিবীতে এই গুণে প্রায় ৩১ প্রজাতির গাছ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং এশিয়ায়। সমগ্র ভারতবর্ষে পাওয়া যায় ৭ প্রজাতির গাছ। বটের কয়েকটি প্রজাতির সঙ্গে এদের মৌলিক সাদৃশ্য রয়েছে। প্রায় ৭০ বছর আগে ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ধাইরার গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। অন্যান্য গাছপালার সঙ্গে এদের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এরা জন্ম ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাধারণত আরেকটি গাছের ওপর নির্ভর করে। অর্কিড কিংবা বট জাতীয় গাছগুলো ঠিক যেভাবে জন্মে ও বেড়ে ওঠে। তবে বট দুভাবেই জন্মাতে পারে।
লেখক: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক তরুপল্লব
এসএ/