রোহিঙ্গা সংকট ও তার সমাধানে করণীয়
পর্ব-১
আজকে রোহিঙ্গা সমস্যা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটি আমাদের দেশে একটি বিরাট সমস্যা। এটি মানবিক বিচারের দিক থেকে যেমন একটি বিরাট সমস্যা, নিরাপত্তার দিক থেকে এমনকি কৌশলগত দিক থেকেও একটি বিরাট সমস্যা। তার কারণ হলো, প্রায় দশ লাখ মানুষ এ যাত্রায় বাংলাদেশে এসেছে। তারা সাংঘাতিক রকম নিগ্রহের শিকার হয়ে আমাদের দেশে এসেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী, শিশু এবং দুস্থ মানুষ।
মিয়ানমারে ‘আরসা’ নামে একটি সংগঠন ভুক্তভোগীদের আক্রমণ করে। ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট যখন আক্রমণ শুরু হয় সেদিন জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান মিয়ানমারের জাতিগত সমস্যার সমাধানের উপর একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। মিয়ানমার সরকার কফি আনান কমিশনকে এ বিষয়ে অবহিত করিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মিয়ানমারের কিছু বোদ্ধা মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বিষয়ে তারা সুপারিশ করেছিলেন যে, রোহিঙ্গাসহ অন্য জাতি গোষ্ঠীগুলোর যে সমস্যা আছে সেগুলো সমাধানে মিয়ানমার সৃজনশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো তৈরি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তাদের সমস্যার মানবিক যে দিকগুলো আছে তা দেখতে হবে। রাজনৈতিক দিক যেগুলো আছে তা দেখতে হবে এবং দেখতে হবে অর্থনৈতিক বিষয়।
এখানে যে কথাটি বলে রাখতেই হবে যে, রাখাইন জনগোষ্ঠী সব থেকে অনুন্নত, সবচেয়ে অশিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের যে নেতিবাচক ধারণা তা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। যার ফলে ২০১২ সালে সেখানে একটি বড় ধরনের রায়ট হয়েছিল। তখন কিছু মানুষ আমাদের এখানে পালিয়ে এসেছিল। ২০১৬ সালে হয়েছিল, তখনও কিছু লোক পালিয়ে এসেছিল। ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনী এবং মিয়ানমার সরকার প্রচণ্ডভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করেছিল। সেখানে গণহত্যা থেকে শুরু করে জাতিসংঘ যেটি বলছে আন্তর্জাতিকভাবেও যা স্বীকৃত, সেখানে অন্যায়-অত্যাচার, ধর্ষণ-নির্যাতন হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের সেখানে টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। সেই আশ্রয়ের সূত্র ধরেই আমরা প্রায় পাঁচ বছর সময় পার করেছি। আমরা যখন আশ্রয় দিয়েছিলাম তখন আমাদের একটা ধারণা ছিল এবং এই ধারনা এখনও আছে যে, এরা সাময়িকভাবে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে। সেখানকার অবস্থার পরিবর্তন হলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদে নিজেদের সম্মান নিয়ে নিজেদের অধিকার নিয়ে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবে। এখানে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা অনুচিত হবে না যে, মিয়ানমার সরকার যে ঘটনা ঘটিয়েছে তার আগেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে।
এভাবে মিয়ানমার সরকার তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং সবশেষে তারই প্রক্রিয়াস্বরূপ রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়ার কৌশলটি তারা ব্যবহার করেছে। আমরা মানবিক বিচারে সাময়িকভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি এবং পরবর্তীতে আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানবিক উদ্যোগকে তারা সমর্থন করেছে। আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেটি আর্থিকভাবে, কূটনৈতিকভাবে, অন্যক্ষেত্রেও তারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন।
ঘটনাটি যখন ঘটেছে তখন আন্তর্জাতিক মহলগুলো ব্যপকভাবে নিন্দা করেছিল এবং ধারণা করা হয়েছিল মিয়ানমার সরকার তাদের ভুলটা বুঝতে পারবে এবং এই জনগোষ্ঠীকে তারা সরিয়ে নিয়ে যাবে। ২০১৭ সালের আগস্টে যখন এই ঘটনাটি ঘটে, আন্তর্জাতিকভাবেও যখন মিয়ানমার সরকার চাপের মুখে ছিল তখন মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে নভেম্বর মাসে দ্বিপাক্ষিক এরেঞ্জিং ব্যবস্থা করে আন্তর্জাতিক মহলে দেখাতে চেয়েছিল যে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু পরপর দুইবার উদ্যোগ নেওয়ার পরেও আমরা একটি মানুষকে এখান থেকে পাঠাতে পারিনি। তার প্রধান কারণ হচ্ছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রধান যে দুটি অভিযোগ রয়েছে তা হলো, সেখানে থাকা মানুষগুলোর বাড়িঘর তারা শুধু ধংস করেনি, বাড়িঘরের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফাইন্ডিং কমিটি তারা সকলে বলছে মিয়ানমারের এই বিষয়টি অমানবিক এবং মানবতাবিরোধী কাজ।
এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা যে কবে যাবে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির জায়গা তৈরি করা, সে বিষয়েও তারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। আমাদের দিক থেকে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে উদ্যোগ নিয়েছি কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। যার ফলে আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি বিভিন্নভাবে। একটি হচ্ছে নিরাপত্তা সংকট দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে সেখানে তাদের এক নেতাকে গুলি মেরে ফেলা হয়েছে। ক্যাম্পে খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। তারপর আরও আটজনকে মারা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িয়ে পড়ছে। যার মধ্যে ইয়াবা পাচার, মানব পাচার ইত্যাদিসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ এমনিতে জনবহুল দেশ। সেক্ষত্রে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে আমরা নিজেরাই নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছি। তারমধ্যে আমাদের এই ছোট্ট জায়গায় থেকে প্রায় দশ লাখ মানুষ যদি এমন বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটি আমাদের জন্যও বড় ধরনের আইনী জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। যা আমরা কখনও চাইনি। আরও একটি বিষয় হচ্ছে এরা যখন এসেছিল তখন যারা ছিল শিশু এখন তারা কিশোর অথবা তরুণ। এরা যে নৃশংসতা দেখে এসেছে এবং নৃশংসতা এখনও তাদের মধ্যে সজীব এবং সেই স্মৃতিটা নিয়েই তারা আছে। ভয়ের কারণ হচ্ছে, তারা তরুণ হওয়ার ফলে যদি সেই প্রতিশোধমূলক মানসিকতার বশবর্তী হয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু করতে চায় অথবা তারা যদি অন্য ধরনের সমস্যা যেমন জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। কাজেই একদিকে নিরাপত্তাসহ নানা জটিলতার আশংকা আছে। বিশেষ করে এই দশ লাখ মানুষ সেখানে থাকার পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের একটি সংঘাতের আশংকা রয়েছে এবং সেটি ক্রমে বর্ধিত হচ্ছে। তাছাড়া এই মানুষগুলোকে ভরণপোষণের একটি খরচ আছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক একটি চাপের মধ্যে আছে। সেই জায়গাতে আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা আমাদের সহযোগিতা করছে।
এই রক্ষণাবেক্ষণে অনেকগুলো কাজ আমাদের করতে হয়। যেগুলো আমাদের জন্য একটা বাড়তি চাপ যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এই সমস্যাটির নেতিবাচক বোঝাটি অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। যে কারণে আমরা বরাবরই বলছি এই সমস্যাটি বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বাংলাদেশ সাময়িকভাবে এই সমস্যাটি বইছে এবং কোনভাবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হোক আমরা চাই না। এই সমস্যা সমাধানে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগও দেখতে পারছি। আমরা তাদের থেকে নৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছি। কিছুটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছি এবং জাতিসংঘের আওতায় আমাদের উন্নয়ন সহযোগী যারা আছে তারা আমাদের অর্থ সংস্থান দিচ্ছে। সেদিক থেকে আমরা বলব যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মোটামুটিভাবে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সঙ্গে আছে। কূটনৈতিকভাবেও কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে আছে। প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গারা যাতে ফিরে যায়, মিয়ানমার যেন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে সেটি তারা চায়।
আন্তর্জাতিক আদালতেও মিয়ানমারে যে গণহত্যা করেছে তার বিরুদ্ধে ওআইসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে একটি মামলা করেছে। এই মামলার ক্ষেত্রে তারা আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তারা যেটি বলেছে তা হলো, এখনও যা চলছে সেটি বন্ধ করতে হবে এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে উপযুক্ত সাজা দিতে হবে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য যে টুলস অথবা পর্যাপ্ত মাল-মশলা দরকার হয় সেক্ষত্রেও তারা কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেনি অথবা বিশেষ কিছু করে দেখাতে পারেনি। তার প্রধান কারণ হলো, জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে আমাদের যারা বন্ধু আছে, যেমন চীন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশও কিন্তু এর স্বপক্ষে শক্তিশালীভাবে দাঁড়াচ্ছে না। ফলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে শক্ত কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না।
চলবে......
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
অনুলিখন: শেহনাজ পূর্ণা
এসপি/এএন/এএস