পল্লি উন্নয়নে এক বাইনোকুলার
কেন আমি তাকে বলব তিনি এই সমাজের এক বাইনোকুলার। সমাজের প্রতিটি আঙ্গিনায় যার বিচরণ সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের এক অভূতপূর্ব সমন্বয় তার প্রতিটি কর্মযজ্ঞে প্রস্ফুটিত। আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্ব- যার, তার নাম ড. আখতার হামিদ খান। উন্নয়নের পথপ্রদর্শক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী, অংশগ্রহণমূলক ও কুমিল্লা পদ্ধতির রূপকার, বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়নের পথিকৃৎ এবং বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খানের জন্ম ১৫ জুলাই ১৯১৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরিলীতে।
তিনি যেমন ছিলেন দীর্ঘদেহী তেমনি ছিলেন সুঠাম। কিন্তু তার অন্তর ছিল আরও বড়। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। ড. খান প্রায় ছয় ফুট লম্বা, চওড়া এবং পায়জামা ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ক্লাসে আসতেন। চেয়ারে বসতেন না। শ্রেণিকক্ষের ডায়াসে রাখা টেবিলের কোনায় ঠেস দিয়ে অনর্গল লেকচার দিতেন।
দুই মেয়ে মরিয়ম ও আমেনা, এক ছেলে গুড্ডুকে রেখে তার প্রথম স্ত্রী ১৯৬৩ সালে মারা যান। পরে অবশ্য তিনি এক পাঞ্জাবি দুহিতাকে বিয়ে করেন এবং এ স্ত্রীর গর্ভে তার এক কন্যা জন্মে বলে জানা যায়। ড. খানের এক ছোট ভাই ষাটের দশকে দীর্ঘদিন কুমিল্লায় অবস্থান করেন। তার ‘My Troubled Life’ নিবন্ধে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন- গড়িয়ে পড়া পাথরের মতোই তার জীবন পরিবর্তিত হয়েছে। তার জীবনের ট্র্যাজিডি তিনি বাঙালি না পাঞ্জাবি এই চিরন্তন ভুল বুঝাবুঝির কোনোদিনই সুরাহা হয়নি। ড. আখতার হামিদ তার বংশের পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে লিখেছেন তাদের ধমনীতে সীমান্ত অঞ্চলের পাঠানদের রক্ত প্রবাহিত ছিল। তারা পাঠান ব্যতীত এ উপমহাদেশের সবার চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত। কিন্তু তার পিতার বিনয়পূর্ণ চরিত্রের কারণে এ নীল রক্তের অহংকার কখনো প্রকাশিত ছিল না।
ড. আখতার হামিদ খান প্রসঙ্গে ড. আবুল হাসনাত গোলাম কুদ্দুস এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, Bottom up পরিকল্পনার কথা বলে নতুন তত্ত্বের আবিষ্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন দেখে আমার মনে হয়, এরা সব নতুন কলম্বাস যারা মনে করেন তারা সদ্য আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন অথচ তারা জানেনই না যে বহু বছর আগেই এই মহাদেশটি কলম্বাস নামক এক নাবিক আবিষ্কার করে গেছেন। ড. খানের ষাট দশকের সেই কথাগুলো প্রমাণ করে তিনি কত দূরদর্শী ছিলেন। ড. আখতার হামিদ খান একজন প্রাক্তন আইসিএস অফিসার এবং তিনি একাডেমি তথা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ছিলেন। তিনি ও আরও ১০ জন ইনস্ট্রাক্টর (স্টাফ অফিসার) নিয়ে একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়।
ড. খান একাডেমির পরিচালক থাকাকালীন পল্লি উন্নয়ন কাজে তার অসামান্য নেতৃত্ব, দক্ষতা, প্রতিভা ও অবদানের জন্য ১৯৬১ সালে তিনি এশিয়ার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এবং ১৯৬৪ সালে মিসিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি তাকে অনারারি ডক্টর অব ল ডিগ্রিতে ভূষিত করেন। ড. খান ষাটের দশকের শেষের দিকে সম্ভবত ১৯৬৮ সালে একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি নিয়ে একাডেমির বোর্ড অব গভর্নরস এর ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একই সঙ্গে তিনি কেটিসিসিএ এর চেয়ারম্যানের অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করেন।
একাডেমিকে কেন্দ্র করে ড. খানের স্বপ্নটি তার ভাষায় আমাদের প্রত্যাশা একাডেমি গ্রাম উন্নয়নের একটি জীবন্ত কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠবে। এখানে জ্ঞান শুধু অর্জিতই হবে না, অর্জিত জ্ঞান চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হবে। তাজা ও সমালোচনামূলক চিন্তা ভাবনাও করা হবে। নতুন নতুন ধারণা সম্বলিত স্কিম বিশ্লেষণ করা হবে। তিনি তার ‘My Explanation’ গ্রন্থে যথার্থ বলেছেন “My friends know how many offers I have rejected since I resigned from ICS, instead I lived the simple and contented life of a teacher”।
তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা ছিল উন্নত। তার জীবদ্দশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে লব্ধ অভিজ্ঞতা তিনি বাংলাদেশে (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে) পল্লি উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তি ছিলেন উপমহাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার পল্লিউন্নয়নের দিশারী। পল্লিউন্নয়নে এক সফল বাইনোকুলার। উন্নয়নের মানসে তার চিন্তাশীল মনন এবং তার গভীর অন্তদৃষ্টির সমন্বয় তাকে অন্যতম সমাজবিজ্ঞানীর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
আখতার হামিদ লিখেছেন, ‘মা আমাকে পুস্তক প্রেমিক করে গড়ে তুলেছেন। উৎসাহিত করেছিলেন আমাকে সরল জীবন যাপন করতে এবং উন্নত চিন্তার অধিকারী হতে। সারা পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের লেখনীর মাধ্যমে সমাজ ও উন্নয়মূলক সকল দর্শন, মতাদর্শ, মতবাদ ও সমকালীন পৃথিবীর সমস্যা নিরসনকল্পে মুক্ত চিন্তা ও প্রগতিশীল সকল ভাবনার সঙ্গে তিনি পরিচিত হওয়ার বিরল সুযোগ পেলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে অবস্থিত সুন্দর লাইব্রেরিটিতে। যুক্তরাজ্যে প্রবেশনার আইসিএস হিসেবে তার প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষাজনিত অবস্থানের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা, মূল্যবোধ ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ মডেলের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
আইসিএস চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর আখতার হামিদ খান ১৯৪৪-৪৭ সময়ে তালা মেরামতকারী ও কাঠমিস্ত্রির কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি কিছুদিন মিরাট নামক পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৪৭-৫০ সালে তিনি দিল্লিতে ড. জাকির হোসেন প্রতিষ্ঠিত জামিয়া মিল্লিয়াতে মাত্র ১০০ রুপি বেতনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। স্বর্ণযুগ প্রতিষ্ঠায় আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ড. আখতার হামিদ খান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৯৫০ সালের এক ক্রান্তিলগ্নে। পঞ্চাশের দশকে পল্লি উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কেও লেখালেখি করেছেন বলে জানা যায়। ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন ১৯৫৪-৫৫ সালে তিনি এক বছরের জন্য সরকারের অনুরোধে Village Agricultural and Industrial Development (V-AID) নামক কর্মসূচি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
দরিদ্র জনগণের প্রতি পরম সহমর্মিতার কারণে তিনি দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লি উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে তিনি উপলব্ধি করলেন বিদেশি সাহায্য তথা রিলিফ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করা যাবে না। বরং দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লি উন্নয়নের জন্য নিরন্তর গবেষণা, প্রয়োগিক গবেষণা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আর এ ধরনের কাজ পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে করার জন্য প্রয়োজন একটি অনন্য প্রতিষ্ঠানের। আখতার হামিদ খানের স্বপ্নের সে প্রতিষ্ঠানটিই পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালের ২৭ মে কুমিল্লা একাডেমি (আজকের বার্ড) নামে কোটবাড়ীতে জন্ম লাভ করে এবং তিনিই সে একাডেমির প্রথম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে আখতার হামিদ খানের পল্লি উন্নয়নবিষয়ক রচনাবলীর মৌলিকত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃক তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
সমাজ উন্নয়নে মৌলিক চিন্তার অধিকারী এবং পল্লি উন্নয়নে মাঠে কাজ করার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই শিক্ষকের বক্তব্য শোনার জন্য ছাত্র ও শিক্ষকরা সমান আগ্রহ সহকারে প্রতীক্ষা করতেন। লেকচার হতো পরিপূর্ণ। ১৯৭৬ সালে ভিজিটিং প্রফেসর ড. আখতার হামিদ খানের এমনি একটি লেকচারের পূর্ব মুহূর্তে তার পরিচয় প্রদানকালে মিশিগানের প্রফেসর Carl Eicher বলেছিলেন, “In the contemporary world there are two authorities in Rural Development. One is Mao Tse Tung and the other is Dr. Akhter Hameed Khan. ড. আখতার হামিদ খানের পরিচয় প্রদানকালীন মিশিগানের প্রফেসরের এই উক্তি হতে আমরা ধারণা করতে পারি পাশ্চাত্যের পল্লি উন্নয়ন গবেষকের দৃষ্টিতে তার মূল্যায়ন কত ঊর্ধ্বে।
ড. আখতার হামিদ খান: কিছু স্মৃতি কথা নিবন্ধে আবদুর রহিম লিখেছেন- তখন আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। ড. খান ক্লাস নিচ্ছেন। এমন সময় কলেজের একজন কর্মচারী এসে ড. খানকে বললেন, স্যার, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব আইয়ুব খান আপনার কাছে টেলিফোন করেছেন। ড. খান একটু থেমে বললেন- বলে দিন এখন তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। এক ঘণ্টা পরে তিনি যেন টেলিফোন করেন। ছাত্ররা অবাক হয়ে গেল। কিন্তু ঠিক এক ঘণ্টা পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খার তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এটা সম্ভব ছিল একমাত্র ড. খানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীর পক্ষেই। আখতার হামিদ খানের হাজারো স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। এসব স্মৃতি লিখে শেষ করা যাবে না।
ড. আবুল হাসনাত গোলাম কুদ্দুস, আখতার হামিদ খান স্মারকগ্রন্থে এক নিবন্ধে লিখেছেন- ড. খান সাহেবের চাকরি জীবনের দুটো গল্প শুনেছিলাম যা নিজে সমাজতত্ত্ব পড়ার পর তার সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করে অভিভূত হয়েছি। যখন সমাজতত্ত্ব পৃথিবীতে শক্তভাবে শিকড় গাড়েনি তখন সমাজ চেতনায় তার অগ্রগামিতা অভাবনীয়। তিনি তখন নেত্রকোনা মহকুমার প্রশাসক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে মহকুমায় দুর্ভিক্ষ চলছে, না খেয়ে ও অসুস্থতায় লোকজন মরছে রাস্তা ঘাটে। এমনি সময়ে একদিন তরুণ মহকুমা প্রশাসক আখতার হামিদ খান উচ্চ বর্ণের হিন্দু আরদালিকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন খরা মৌসুমে। একটি প্রায় মরা খালের পাড়ে এসে তিনি একটি লোককে অসুস্থতায় কাতরাতে দেখেন। ড. খান তার সহগামীকে প্রস্তাব দেন লোকটাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আরদালি এ প্রস্তাব কিছুতেই রাজি হয়নি কারণ লোকটি জাতে মেথর এবং তাকে স্পর্শ করলে ওর জাত যাবে। খান সাহেব যখন বুঝলেন একে দিয়ে হবে না তখন তিনি তার পায়ের জুতা জোড়া খুলে আরদালির হাতে দিয়ে লোকটাকে কাঁধে নিয়ে খাল পার করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। পৌঁছে দেওয়ার পর তিনি আরদালির হাত থেকে জুতা জোড়া নিয়ে পায়ে না পরে আরদালিকে কয়েকটি ঘা দিয়ে বলেছিলেন, তুই আমার গরুর চামড়ার তৈরি জুতো নিতে পারলি আর জীবন্ত মানুষ ধরতে পারলি না। আমার কাছে ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে হিন্দু সমাজের বর্ণবাদের অভিশাপ সম্পর্কে খান সাহেবের কী স্বচ্ছ ধারণা ছিল!
বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তাকে কুমিল্লায় অবস্থান করে কুমিল্লা একাডেমির জন্য তথা কুমিল্লা কর্মসূচির পরিপূর্ণতার জন্য কিছুকাল কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাকে বলা হলো, আপনাকে বগুড়া একাডেমির উপদেষ্টা হিসেবে আনা হয়েছে। দয়া করে বগুড়ায় অবস্থান করে বগুড়ার জন্যই কাজ করুন। কর্তৃপক্ষের এই পরামর্শ স্বাধীনচেতা আখতার হামিদ খানের আত্ম-অভিমানের আঘাত হানল। তার কনসালটেন্সির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি বগুড়া ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তার স্বপ্নের সৃষ্টি বার্ডে এলেন। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করলেন। সবাইকে দাওয়াত করে একবেলা খাওয়ালেন। বিদায়ী ভাষণে বললেন আমি আর কিছুই চাই না। আমার কবরের জায়গা যেন বার্ডে হয়। সেই সাড়ে তিন হাত জায়গা তোমাদের নিকট ভিক্ষা চাইছি।
শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য তখন তিনি বয়স্ক শিক্ষা চালু করেন। আমেরিকা থেকে বিঙার নামে এক বিশেষজ্ঞ এনে বয়স্ক লোকদের ডেকে এনে শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। এই স্কুল রাতের বেলায় চালাতেন। হুক্কা ও তামাকেরও ব্যবস্থা থাকত, যাতে বয়স্ক লোকেরা আগ্রহে লেখাপড়া করতে পারে। জারি গান, সারি গানেরও ব্যবস্থা ছিল। এইভাবে কুমিল্লাতে শিক্ষার মান উন্নয়ন করেন। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তাকে পাক সরকার জোর করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে যখন সরকার তাকে পুনরায় বাংলাদেশে আনে, তখন তিনি বলেছিলেন- আমার অসমাপ্ত কাজগুলো করার জন্য আমাকে সুযোগ দিন। এতে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়াতে তিনি রাগ করে চলে যান। তিনি পাকিস্তানে গিয়েও বসে থাকেননি। তিনি ওখানে গিয়ে সুইপারদের একত্র করে কুমিল্লার মতো কাজ আরম্ভ করেন। পাকিস্তানে কাজ করেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি জ্ঞানী-গুণী হয়ে কোনোদিন অর্থলোভে প্রলুব্ধ হননি।
উন্নয়নের জন্য আজকের ক্ষুদ্র ঋণ, অংশীদারিত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন, bottom up approach ও সুশাসন অপরিহার্য বলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বরং বাস্তব প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন যে কথাগুলো বলতে যত সহজ কার্যে পরিণত করা কত যে কঠিন। যারা আজকে পুরোনো সেই কথাগুলোকে নতুনভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চাইছেন তাদের উচিত ড. খানের পরীক্ষিত প্রকল্পগুলোর সফলতা ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন করে তাদের কৌশলসমূহ নির্ধারণ করা, আর সেই সঙ্গে তারা নিজেদের নব্য কলম্বাস না ভেবে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টার এই পথিকৃতের কর্মগুলোকে প্রচার করা ও স্বীকৃতি দেওয়া। বার্ড বাংলাদেশের একটা গৌরব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ এর নাম জানে। কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ড. খানের উক্ত একাডেমিকে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত করেছেন। ড. খান প্রচণ্ড একাগ্রতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে বার্ডকে গড়ে তুলেছিলেন এবং বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছিলেন। এই দেশকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন এ দেশের মানুষকে। এদেশের উন্নতির জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) প্রতিষ্ঠা করে।
দারিদ্র্য বিমোচন কীভাবে করতে হবে- দেশের পল্লি উন্নয়নের কৌশলগত দিক কী এবং সমবায় সমিতি এ ক্ষেত্রে কী অবদান রাখতে পারে এসব পরিকল্পনা নিয়ে গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য একটি নতুন দিকদর্শন রচনা করেন। অনেক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়ার কারণে তাকে বাইনোকুলার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ১০০ বছর পরের পল্লি উন্নয়ন ভাবনাকে সফল করতে অন্তরদৃষ্টির বাইনোকুলার দিয়ে অবলোকন করেছেন। ড. আখতার হামিদ খানের আধ্যাত্মিক চরিত্র তাকে পল্লি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে নিয়োজিত অন্যান্য হাজারো ব্যক্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক একটি অবস্থানে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করেছে। ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর আমেরিকার ইন্ডিয়ানা স্টেট-এর একটি হাসপাতালে ৮৫ বছর বয়সে এই মহামানবের মৃত্যু ঘটে।
ড.সারিয়া সুলতানা: লেখক ও গবেষক এবং সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ২৪ডটকম
এসএন