কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া বধ্যভূমিতে আজও শোনা যায় নীরব কান্না
মৃত্যুঞ্জয়ী তোমরা, আমাদের প্রেরণা,
তোমাদের ত্যাগেই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা...
তোমাদের মৃত্যুও হতে পারত স্বাভাবিক নিয়মে প্রিয়জনের চোখের জল, আর ভালোবাসার ছোঁয়া নিয়ে। অথচ মুক্তিপাগল শহিদ সারণীতে ঘাতকদের বুলেট আর বেয়নেটের খোঁচায়, নাম না জানা লাশ হলে প্রিয় স্বদেশে! অবশেষে, ইতিহাস হলে তোমরা। মুক্তিযুদ্ধের শোকগাথার সাক্ষী কুষ্টিয়ার বৃহৎ বিত্তিপাড়া বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় দুই পিকআপ ভর্তি মানুষের কঙ্কাল।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার উজানগ্রাম ইউনিয়নের বিত্তিপাড়া ছিল সদর উপজেলার বিত্তিপাড়া বাজার ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় মধ্যবর্তী স্থান। ব্রিটিশ আমলে সেখানে ইংরেজদের একটি কুঠিবাড়ি ছিল, যার অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ইংরেজরা গরিব প্রজাদের এখানে এনে নীলচাষ বা জমির খাজনা না দিলে শাসন ও নির্যাতন করত–যা সাহেবদের নীলকুঠি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই জায়গাটি তাদের ক্যাম্প করার জন্য বেছে নেয়। কুষ্টিয়া থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে বিত্তিপাড়া বাজার। একাত্তরে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে পাকিস্তানি হানাদাররা ক্যাম্প বসায়। কুষ্টিয়া পিস কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদের নেতৃত্বে এ সময় বিহারি, রাজাকার ও পিস কমিটির সদস্যসহ স্বাধীনতা বিরোধীরা হয়ে উঠে বেপরোয়া।
এই ক্যাম্পটি ছিল হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর এক অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। উপরন্তু ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে এসে যোগ হওয়া কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে সংযোগকারী একমাত্র সড়ক। যুদ্ধের সময় চলাচলকারী পরিবহন থামিয়ে চেক করা হতো এবং সন্দেহভাজন অসংখ্য নিরীহ পুরুষ-নারীকে নামিয়ে ক্যাম্পে নেওয়া হতো। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন ও অত্যাচারের পর মারা গেলে ক্যাম্পের আশপাশেই পুতে রাখা হতো কিংবা পুকুর-খাদে ফেলে দেওয়া হতো। এই ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী আশপাশের সব ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ, লুটপাট, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ করত। অপরদিকে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার, শান্তি কমিটি ও বিহারিদের ভোগের সামগ্রী হয় অন্তত দুই হাজার মা-বোন। পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পটিতে সুরক্ষিত বাংকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার ক্যাম্পটি আক্রমণ করে; কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। ৯ ডিসেম্বর ক্যাম্পটি মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর দখলে আসে। ক্যাম্পটি দখলের পর কয়েকজন নির্যাতিত জীবিত পুরুষ ও নারীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার ৩২ বছর পর বধ্যভূমি হিসেবে শনাক্তের পর ২০০৩ সালে কৃষি বিভাগের জায়গাটিতে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও এখন তা অরক্ষিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জন স্টোন হাউজ ও ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলামের উপস্থিতিতে দুই পিকআপ বোঝাই মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুলি ও হাড় উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যতগুলো বৃহৎ বধ্যভূমি রয়েছে, বিত্তিপাড়া বধ্যভূমি তার মধ্যে অন্যতম একটি।
এই বধ্যভূমিতে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কমান্ডার নাছিম উদ্দিন আহম্মেদ, কুষ্টিয়া জেলা ইউনিট কমান্ডো ও কমান্ডের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং কমান্ডার আবু তৈয়ব (কুষ্টিয়া সদর উপজেলা কমান্ডো) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিত্তিপাড়া বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। ১২ নভেম্বর ২০১২ সালে এই বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের শুভ উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক এবং ড্রইং ডিজাইন ও পরিকল্পনায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মো. আব্দুল মান্নান।
কুষ্টিয়া উন্নয়নের রূপকার মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদফতরের সহযোগিতায় ‘বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’ এর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের যেসব এলাকায় গণহত্যা হয়েছে সেসব এলাকায় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। আবার অনেক জায়গায় বধ্যভূমি বেহাল, সেগুলো সংস্কারের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা হবে।”
যুগে যুগে এ জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে এ জাতির স্বাধীনতার জন্য কত লোক তাদের জীবন দিয়ে গেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর হাতে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে আরও বেশি গণমুখী কার্যক্রম প্রয়োজন।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এসএ/