সড়কে যাত্রীদের সুরক্ষা দেবে কে?
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাহাকার নিরসনের দায়িত্ব যাদের, তাদের বাগাড়ম্বর কথামালা ছাড়া বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বিশেষ করে যাত্রীদের সুরক্ষার বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। সর্বশেষ মাদারীপুরের শিবচরের এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহনের বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে অকালে ঝরেছে ২০ জনের তাজা প্রাণ। অন্তত ৩০ জন আহতের অনেককেই আজীবন পঙ্গুত্বে বিকলাঙ্গ দুর্বিসহ জীবনযাপন করতে হবে। এ দুর্ঘটনার পর যথারীতি গঠন করা হয়েছে কয়েকটি তদন্ত কমিটি। এইসব কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার আগেই হয়ত আরেকটি দুর্ঘটনার খবর এসে যাবে। আর তাতেই ওইসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ধামাচাপা পড়ে যাবে। যারা দায়ী তারাও হাফ ছেড়ে বেঁচে যাবে। নিহত ও আহতদের পরিবারের আর্তনাদ শোনার কারো সময় থাকবে না। এভাবেই চলছে এবং চলবে! কার সাধ্যি গড্ডালিকা প্রবাহের পরিবর্তন আনার?
গণমাধ্যমে শিবচরে এই বাস দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নানা তথ্য ও বিশ্লেষণ ইতোমধ্যে চলে এসেছে। এতে দেখা যায়, প্রথমত: গাড়িটি ছিল বেপরোয়া গতির। এই এক্সপ্রেসওয়েতে সাধারণত ৮০ কিলোমিটার সীমাবদ্ধ থাকলেও গাড়িটির গতি ছিল নাকি ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি। যাত্রীরা আস্তে চালানোর জন্য অনুরোধ করলেও চালক কর্ণপাত করেনি। দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের মতো ভালোমানের সড়কে উঠলেই চালকরা পঙ্খীরাজ বনে যান। বিদেশে নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত গতিতে উঠলেই হাইওয়ে পুলিশ তৎক্ষণাৎ হাজির হয়ে ব্যবস্থা নেয়। আমাদের এই এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির অতিরিক্তি গতি মনিটরিংয়ের সেই ব্যবস্থা আছে কি না জানা নেই। যদি না থাকে তাহলে অবিলম্বে এই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এক্সপ্রেসওয়ের মতো আধুনিক সড়ক নির্মাণে এই ব্যবস্থা না থাকাটা হবে অত্যন্ত খারাপ নজির। এজন্য যারা এর পরিকল্পনাকারী তাদেরও দায় আছে। আর যদি এই ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কেন হাইওয়ে পুলিশ সময়মতো দুরন্ত গতির এই গাড়িটির বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিল না তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
দ্বিতীয়ত: আহত যাত্রীদের অনেকে বলেছেন, গাড়িটি চলার সময় চালক ও সহকারীর কথায় বুঝা গেছে, চাকার সমস্যা আছে। তাহলে চালক গাড়িটি থামিয়ে এর সমাধান করল না কেন? এ ছাড়া গাড়িটির ফিটনেসও ছিল না। এর আগেও গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। এতে নিহত হয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ চার জন। তাহলে ফিটনেস ছাড়া গাড়িটি কীভাবে মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ালে? তার দায় দায়িত্ব কার? ইতোমধ্যে বিআরটিএর গৎবাঁধা বক্তব্য, লোকবলের অভাবে তাদের পক্ষে ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলাচল মনিটরিং করা সম্ভব নয়। পুলিশের জবাব এখনো জানা যায়নি। হয়ত বলা হবে তাদেরও লোকবলের অভাব! তাহলে ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলাচল কি অবাধে চলতে থাকবে? আর এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে! ইতোমধ্যে ইমাদ পরিবহনের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত এই মামলায় ফলপ্রসূ কিছু হয় কি না তা-ই এখন দেখার বিষয়।
তৃতীয়ত: চালক ক্লান্ত ছিল বলে ঘুম চোখে গাড়ি চালানোয় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে— এমনও বলা হচ্ছে। গাড়িটির চালক জাহিদ হাসানও (৪০) নিহতদের তালিকায়। তার ছেলের বক্তব্য, তার বাবা একটানা ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারেননি। এক্ষেত্রে দায় অবশ্যই পরিবহন সংস্থাটির। তাদের জানার কথা, চালককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না দিলে বিপদের আশঙ্কা আছে। তারপরও তারা সেরকম ব্যবস্থা নেয় না কেন? পরিবহন মালিক সমিতি ও চালক সমিতির নেতারা কেন চালকদের পর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে পারে না? অভিযোগ আছে, এই সমিতিগুলোর নেতাদের চাঁদাবাজি ছাড়া সাধারণ চালকদের বা যাত্রীদের সুরক্ষার দিকে কোনো মনোযোগ নেই!
সাধারণত সড়ক পরিবহন আইনের কোনো ধারা উপধারা নিয়ে পরিবহন সমিতিগুলোর নেতারা তাদের স্বার্থরক্ষায় সব সময় সোচ্চার থাকে! কিন্তু এরকম একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর তাদের কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি। চালকদের গাড়ি চালানোর জন্য সময়ে সময়ে সচেতন করার কাজটি তারাই করতে পারে। কিন্তু সেরকম কোনো কর্মসূচি মনে হয় না তাদের আছে। সড়কের কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ’রও হয়ত নেই!
চতুর্থত: যাত্রী সুরক্ষার বিষয়টি কে দেখবে বা কারা তদারকি করবে? সাধারণত: এ রকম ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় বিভিন্ন পর্যায় থেকে। কিন্তু শিবচরের দুর্ঘটনার পর এরকম কোনো সহায়তার ঘোষণা জানা যায়নি। দুর্ঘটনা কবলিত বাসটির মালিকের কাছ থেকেও নিহত ও আহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা আসেনি। তাই নিহত ও আহতদের পরিবার এই বিশাল ক্ষতি নিয়ে কীভাবে দিনযাপন করবে? বিদেশে যাত্রী বিমা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এখনো যাত্রীদের সার্বজনীন বিমার আওতায় আনা হলো না? এ নিয়ে যাত্রী সুরক্ষা সমিতিগুলো বারবার আহ্বান জানালেও কারো সাড়া নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পরিবহন মালিক, শ্রমিক সমিতিগুলোর উদ্যোগ ছাড়া যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই আর কতো প্রাণ গেলে তাদের টনক নড়বে—সেটাই এখন প্রশ্ন?
এ ছাড়া পরিবহন সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা তোলারও অভিযোগ আছে। আর এ চাঁদার ভাগ শুধু নেতাদের পকেটে না দিয়ে নিহত ও আহতদের পরিবারের জন্যও কিছু দিতে পারে বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকেও একটি তহবিল গঠন সময়ের দাবি। বিআরটিএ’র বিভিন্ন সেবায় এই তহবিলের জন্য অর্থ নেওয়া যেতে পারে। তাহলে অন্তত: দুর্দশাগ্রস্ত এই পরিবারগুলো চরম সংকটে কিছুটা হলেও বেঁচে থাকার অবলম্বন পেতে পারে।
ইব্রাহিম আজাদ: কবি ও সাংবাদিক
আরএ/