চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঐতিহ্যের সন্ধানে
এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হলাম রাজশাহী কলেজে। বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। এই কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করেছিলাম ১৯৮১ সালে। সাইন্স, আর্টস এবং কমার্স মিলিয়ে আমাদের ব্যাচের আমরা ছিলাম প্রায় ৭৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী। এর বহু বহু বছর পর আমাদের ব্যাচের পুরনো বন্ধুরা একত্রিত হয় গড়ে তুলেছি একটি সংগঠন, যার নাম ৮১’র বন্ধন।
৮১’র বন্ধনের ৪০ বছর পুর্তি এবং ৩য় পুনর্মিলনীর আয়োজন চলছিল অনেকদিন ধরে। কোভিডের কারণে তা পিছিয়ে যায়। অবশেষে সকল বাধার উত্তরণ ঘটিয়ে জাকজমকপূর্ন অনুষ্ঠান আয়োজন হলো এবার জানুয়ারি মাসের শেষ শুক্রবার। সারাদিন বেশ হৈ হুল্লোড় করে কাটল। পরদিন শনিবার ছিল পিকনিকের আয়োজন। আমরা আট বন্ধু পরিকল্পনা করলাম, খুব ভোরে রওয়ানা হয়ে কিছুটা বেরিয়ে এসে পিকনিকে যোগ দেবার। গন্তব্য হলো প্রাচীন গৌড়, সে এক সময়ের বাংলার রাজধানী।
ইতিহাসের নিদর্শন হিসেবে সেখানে এখনো কিছু স্থাপনা আছে, উদ্দেশে হলো সেগুলো ঘুরে দেখা।
গৌড় সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। ভারতবর্ষের মধ্যযুগে সবচাইতে সমৃদ্ধ সময়কালে বঙ্গের রাজধানী ছিল গৌড়। নগরটির নাম কখনো ছিল গৌড়, এর আগে লখনৌতি, আবার পরে কিছু কালের জন্য জান্নাতাবাদ। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের একটি জরিপ অনুসারে গৌড় নগরীর জনসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ, যা ছিল তখন জনসংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম নগর, এবং সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকা। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশ বিভাগের সময় অঞ্চলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বড় অঞ্চলটি চলে যায় ভারতের অধীনে, ছোট অংশটি পড়ে পুর্ব পাকিস্তান, বা আজকের বাংলাদেশের অধীনে, বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষ এবং চীনের সমৃদ্ধির ইতিহাস নিয়ে নানা উপাখ্যান আছে। এগুলোর সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করতে গত শতাব্দীর শেষদিকে Organization for Economic Cooperation and Development (OECD) এর পক্ষ থেকে পৃথিবীর অর্থনীতির ইতিহাস নিয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ Angus Maddison-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যগুলো সিরিজ আকারে প্রকাশিত হতে থাকলে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০০১ সালে প্রকাশিত The World Economy: A Millennial Perspective বইটি ছিল এই সিরিজের অন্যতম।
এই গবেষণার উঠে আসে, খিষ্টাব্দ ১ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থনীতিতে বিশ্বে প্রথম স্থানে ছিল ভারত, ২য় স্থানে ছিল চীন। শুধু তাই নয়, গোটা বিশ্বের জিডিপির প্রায় ৩৪ শতাংশ ছিল ভারতবর্ষের, আর ২৬ শতাংশ ছিল চীনের দখলে। অন্য কোনো দেশের সম্পদ লুটপাট না করেও ১০০০ বছর যাবত বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রথম স্থান ধরে রাখা হলো এক নজিরবিহীন ইতিহাস। এই সমৃদ্ধই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতবর্ষের জন্য। ইউরোপ থেকে বানিজ্যের নামে আসা আরম্ভ হয় ক্ষমতাবানদের। বানিজ্য আর শাসনের নামে চলে যথেচ্ছ লুটতরাজ।
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন ভারতবর্ষের দায়িত্বভার নেয়, তখনও ২৪.৫ শতাংশ জিডিপি নিয়ে ভারতবর্ষ ছিল বিশ্ব অর্থনীতির শিখরে। ১৮০০ সাল আসতে আসতে তা নেমে যায় ২০ শতাংশে, ২৯ শতাংশ নিয়ে প্রথম স্থানে উঠে যায় চীন। ১৯০০ সাল নাগাদ কমে গিয়ে তা দাঁড়ায় মাত্র ১.৭ শতাংশ । এক সময়কার স্বর্ণ ও শিল্প বানিজ্যে সমৃদ্ধ দেশটি লুটপাটের পর সব খুইয়ে কেবল কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে।
গৌড়ের ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরনো। গৌড় রাজ্য এবং গৌড় শহর দুটি পৃথক বিষয়। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ ৪র্থ শতাব্দিতে গুপ্ত সাম্রাজ্য সৃষ্টির আগেও গৌড় সাম্রাজ্য ছিল বলে অভিমত দেন। তবে সন্দেহাতীতভাবে সম্মিলিত বঙ্গের প্রথম অধিকর্তা হিসেবে যার নাম আসে, তিনি ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। ৫৯০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ সময়কাল তিনি শাসন করেছিলেন। তারই সময় গৌড় শহরকে বঙ্গের (বা তৎকালীন গৌড় সাম্রাজ্যের) রাজধানী হিসেবে স্থাপন করা হয়। তারই সময় প্রথমবার বাংলায় দিনপঞ্জি প্রচলন করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মোঘল সম্রাট আকবর পুনর্বিন্যাশ করে প্রচলন করেন।
এর পর ক্রমান্বয়ে আসে পাল বংশ ও সেন বংশ। মূলত বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী বংশোদ্ভূতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বঙ্গ তথা ভারতবর্ষের শাসন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত মোহাম্মদ ঘুরি। তারই আক্রমণে ১১৯৭ সাল থেকে ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে মুসলিম শাসকদের অন্তর্গত হতে থাকে। ১২০৩ সালে বঙ্গ দখলে মোহাম্মদ ঘুরির একজন সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী’র ইতিহাস আমরা সকলেই ছোটবেলায় পড়েছি। মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে লক্ষ্মণ সেনকে পরাভূত করা হলে এর মাধ্যমেই বঙ্গে আরম্ভ হয় মুসলিম শাসকদের ইতিহাস। যা পরবর্তী সময়ে সুলতানী ও মোঘল রাজত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১১৯৭ সাল থেকে আরম্ভ করে ১২০৬ সালে বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত কত সহস্র বৌদ্ধ সাধু হত্যা করা হয়েছিল তার হিসেব নেই। বিহারে ৪২৭ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত ঐতিহাসিক নালন্দা মহাবিহারটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল তারই নির্দেশে।
১২০৬ সালে মোহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু হলে তার মূল সেনাপতি তুর্কি বংশোদ্ভূত কুতুব উদ্দিন আইবক দিল্লীর শাসনভার গ্রহণ করেন। তারই মাধ্যমে ভারতবর্ষ জুড়ে আরম্ভ হয় সুলতানী আমল, যা ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
এদিকে বঙ্গে খলজী সাম্রাজ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে (১২০৮-১২১০ এবং ১২১২-১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ) গৌড়ের অধিকর্তা ছিলেন ইওয়াজ খলজী, যিনি পরে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ শাহ নাম ধারণ করেছিলেন। তারই সময়কালে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডকে রাজশাহী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। বঙ্গের প্রথম নৌবহর প্রচলন এবং গৌড় নগরের নিরাপত্তাবলয় নির্মাণও হয়েছিল তারই সময়ে। বঙ্গের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরকে বন্যামুক্ত করার জন্য বাধ নির্মান প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার সময়, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম বাধ প্রকল্প হিসেবে সুখ্যাত।
নাফিসুর রহমান: ডিস্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপ কনসালটেন্ট