শবে বরাত বা নিসফি শাবান’র তাৎপর্য
শাবান মাস একটি মুবারক মাস। বিভিন্ন সহিহ হাদিস থেকে আমার জানতে পারি যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোজা পালন করতেন। শাবান মাসের সিয়ামই ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এ মাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মাসে রাব্বুল আলামিনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালোবাসি যে— রোজা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।’ (নাসাই)
হাদিসে এবং সাহাবি-তাবিয়াদের যুগে ‘লাইলাতুল বারাআত’পরিভাষাটি ছিল না। হাদিসে এ রাতটিকে ‘লাইলাতু নিসফি শাবান’ বা ‘মধ্য শাবানের রাত’ বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাতে তার সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ)
আট জন সাহাবির সূত্রে বিভিন্ন সনদে এ হাদিসটি বর্ণিত। শবে বরাত বিষয়ে এটিই একমাত্র সহিহ হাদিস। এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতটি ফজিলতময় এবং এ রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের ক্ষমা করেন। আর ক্ষমা লাভের শর্ত হলো শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া। এ দুটি বিষয় থেকে যে ব্যক্তি মুক্ত হতে পারবেন তিনি কোনোরুপ অতিরিক্ত আমল ছাড়াই এ রাতের বরকত ও ক্ষমা লাভ করবেন। আর যদি এ দুটি বিষয় থেকে মুক্ত হতে না পারি, তবে কোনো আমলেই কাজ হবে না। কারণ ক্ষমার শর্ত পূরণ হলো না। দুঃখজনক হলো— আমরা শবে বরাত উপলক্ষে অনেক কিছুই করি, তবে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এ দুটি শর্ত পূরণের চেষ্টা খুব কম মানুষই করেন।
শিরকের ভয়াবহতা আমরা জানি। আরেকটি ভয়ংকর পাপ হিংসা-বিদ্বেষ। মহাপাপ হওয়া ছাড়াও এ পাপের দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, তা অন্যন্যা নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, আগুন যেমন খড়কুটো ও খড়ি পুড়িয়ে ফেলে হিংসাও তেমনি মানুষের নেক আমল পুড়িয়ে ফেলে। এ পাপের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো— আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হওয়া। উপরের হাদিস থেকে আমরা তা জেনেছি। এ বিষয়ে অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষদের আমল প্রতি সপ্তাহে দুবার পেশ করা হয়— প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার। তখন সব মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করা হয়, কেবলমাত্র যে বান্দার সঙ্গে তার ভাইয়ের বিদ্বেষ-শত্রুতা আছে সে ব্যক্তি বাদে। বলে দেওয়া হয়, এরা যতক্ষণ না ফিরে আসে ততক্ষণ এদের বাদ দাও। (মুসলিম)
মুসলিম ভাইকে ভালোবাসা ও তার কল্যাণ কামনা যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি ভয়ংকর হারাম পাপ হলো মুসলিম ভাইকে শত্রু মনে করা, তার প্রতি হৃদয়ের মধ্যে অশুভকামনা ও শত্রুতা পোষণ করা । কোনো কারণে কাউকে ভালোবাসতে না পারলে অন্তত শত্রুতা ও অশুভকামনার অনুভূতি থেকে হৃদয়কে রক্ষা করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব।
কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে— হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং ঈমানের ক্ষেত্রে অগ্রণী আমাদের ভাইদের ক্ষমা করুন। আর আপনি আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল ইচ্ছা রাখবেন না। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি মহা করুণাময় ও পরম দয়ালু। (সুরা হাশর, আয়াত নম্বর-১০)
আসুন আমরা সবাই আল্লাহর দরবারে এভাবে বারবার প্রার্থনা করে নিজেদের অন্তরকে সব হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংবোধ থেকে পবিত্র করি। আসুন আমরা শবে বরাত উপলক্ষে সব প্রকার শিরক, হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে তাওবা করি ও হৃদয়কে মুক্ত করি।
জাগতিক কারণে বা ধর্মীয় মতভেদের কারণে যাদের প্রতি শত্রুভাব বা বিদ্বেষ ছিল তাদের জন্য দোয়া করি। তাহলে আমাদের কয়েকটি লাভ হবে। প্রথমত, কঠিন পাপ থেকে তাওবা হলো। দ্বিতীয়ত, শবে বরাতের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ হল। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সহিহ হাদিস থেকে আমরা জানি যে, হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হৃদয় লালন করা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অন্যতম সুন্নাত। যার মনে হিংসা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা নেই— তিনি অল্প আমলেই জান্নাত লাভ করবেন এবং জান্নাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহচর্য লাভ করবেন।
এক্ষেত্রে শবে বরাত সর্ম্পকে কয়েকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রথমত, এ রাতের নামাজের কোনো সুনির্ধারিত নিয়ম হাদিসে বলা হয়নি। অমুক সুরা অতোবার পড়ে, অতো রাকাত সালাত আদায় করলে অতো সাওয়াব ইত্যাদি যা কিছু বলা হয় সবই জাল ও বানোয়াট কথা। মুমিন তার সুবিধামত যে কোনো সুরা দিয়ে যে কয় রাকাত সম্ভব সালাত আদায় করবেন এবং দোয়া করবেন।
দ্বিতীয়ত, জিয়ারত, দোয়া, সালাত সবই একাকী আদায় করাই সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবিরা কেউ কখনোই এ রাতে মসজিদে সমবেত হননি বা সমবেতভাবে কবর জিয়ারত করতে যান নি। সব নফল নামাজ ও তাহাজ্জুদের মতো এ রাতের নামাজও নিজের বাড়িতে পড়া সুন্নত। হাদিস থেকে আমরা জানি যে, এতে বাড়িতে বরকত নাযিল হয়। এ ছাড়া এতে স্ত্রী ও সন্তানরা উৎসাহিত হয়।
শবে বরাত হলো ইবাদত বন্দেগি ও দোয়া-ক্রন্দনের রাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একে খাওয়া-দাওয়া ও উৎসবের রাত বানিয়ে ফেলেছি। এ রাতে হালুয়া-রুটি বা ভালো খাবার খাওয়া ও এরুপ করার মধ্যে কোনো সাওয়াব আছে বলে কল্পনা করা ভিত্তিহীন— যা কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। এ রাতে আলোকসজ্জা, কবর বা গোরস্তানে আলোকসজ্জা, বাজি ফোটানো ইত্যাদি আরও গুরুত্বর অন্যায়। এগুলো মূলত এ রাতের ইবাদত ও আন্তরিকতা নষ্ট করে এবং মুমিনকে বাজে কাজে ব্যস্ত করে।
ফরজ ও নফলের সীমারেখা অনুধাবন করা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ। অনেকে শবে বরাতের রাত্রিতে কম বেশি কিছু নামাজ পড়েন, কিন্তু সকালে ফযরের নামাজ জামাতে পড়ছেন না বা মোটেই পড়ছেন না। এর চেয়ে কঠিন আত্মপ্রবঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। শবে বরাত বা অনুরুপ রাত বা দিনগুলোতে আমরা যা কিছু করি না কেন সবই নফল ইবাদত। সারা জীবনের সকল নফল ইবাদতও একটি ফরজ ইবাদতের সমান হতে পারে না। জীবনে যদি কেউ শবে বরাতের নামও না শুনে, কিন্তু ফরজ-ওয়াজিব ইবাদত আদায় করে যায় তবে তার নাজাতের আশা করা যায়। আর যদি জীবনে ১০০টি শবে বরাত পরিপূর্ণ আবেগ নিয়ে ইবাদত করে কাটায়, কিন্তু একটি ফরজ ইবাদত ছেড়ে দেয় তবে তার নাজাতের আশা থাকে না। আল্লাহর ফরজ নির্দেশ অমান্য করে এক রাতে কান্নাকাটি করে তার কাছ থেকে ভাল ভাগ্য লিখিয়ে নেওয়ার মত চিন্তা কি কোনো পাগল ছাড়া কেউ করবে? ফরজ ইলম, আকিদা, নামাজ, যাাকাত, রোজা, হজ্ব, হালাল উপর্জন, সাংসারিক দায়িত্ব, পিতা-মাতা, সন্তান ও স্ত্রীর দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজ থেকে নিষেধ ইত্যাদি সকল ফরজ ইবাদত, যার ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্য, তাকে ততটুকু অবশ্যই পালন করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুমিন যদি একটু আগ্রহী হন তবে প্রতি রাতই তার জন্য শবে বরাত। বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম সংকলিত সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতি রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে বলেন, আমিই রাজাধিরাজ, আমিই রাজাাধিরাজ। আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। প্রভাতের উন্মেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে তিনি বলতে থাকেন। (মুসলিম)
অন্যন্যা হাদিসে বলা হয়েছে যে, মধ্যরাতের পরে এবং বিশেষত রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পরে তাওবা কবুল, দোয়া কবুল ও হাজত মেটানোর জন্য আল্লাহ বিশেষ সুযোগ দেন।
সুপ্রিয় পাঠক, তাহলে আমরা দেখছি, শবে বরাতের যে ফজিলত ও সুযোগ, তা মূলত প্রতি রাতেই মহান আল্লাহ সকল মুমিনকে প্রদান করেন। শবে বরাত বিষয়ক হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায় যে, এ সুযোগ সন্ধ্যা থেকেই। আর উপরের সহিহ হাদিসগুলো থেকে জানা যাায় যে, প্রতি রাতেই এ সুযোগ শুরু হয় রাতের এক তৃতীয়াংশ- অর্থাৎ ৩/৪ ঘণ্টা রাত অতিবাহিত হওয়ার পরে, রাত ১০/১১টা থেকে। কাজেই মুমিনের উচিত শবে বরাতের আবেগ নিয়ে প্রতি রাতেই সম্ভব হলে শেষ রাত্রে, না হলে ঘুমানোর আগে রাত ১০/১১টার দিকে দুচার রাকআত সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের সব কষ্ট, হাজত, প্রয়োজন ও অসুবিধা জানিয়ে দোয়া করা, নিজের যা কিছু প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং সব পাপ-অন্যায় থেকে ক্ষমা চাওয়া। কয়েকমাস এরুপ আমল করে দেখুন, জীবনটা পাল্টে যাবে। ইনশাআল্লাহ নিজেদের জীবনে আল্লাহর রহমত অনুভব করবেন। আল্লাহ আমাদের তার নির্দেশিত পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, ঢাকা
আরএ/