পর্যটনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ
অর্থনীতিতে চাহিদা তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে গেলে এর মূল্য বাড়ে। আবার সরবরাহ বাড়লে ওই দ্রব্যের মূল্য কমে। তবে সরবরাহকারী ও বিক্রেতা এক হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করলে অর্থনীতির চাহিদা তত্ত্ব আর কাজ করে না। তখন দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় এবং ইচ্ছামতো মূল্য বাড়ানো হয়। ফলে ক্রেতা সাধারণ তাদের ভোক্তা অধিকার হারান। পণ্যের ন্যায্য মূল্য ছাড়াও ভোক্তা অধিকারের মধ্যে আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত। যেমন- পণ্যের মান, মূল্য অনুযায়ী মান, সরবরাহের সময়, সরবরাহের স্থান ইত্যাদি।
সমাজাবজ্ঞানীরা বলছেন যে, এই সব কিছু ঠিক রাখতে হলে সুশাসন ছাড়া সম্ভব নয়। সুশাসনের অভাবে বাজারের ভাষা ও জনগণের ভাষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক হয়ে হয়। বাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয় এবং মানুষের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো পীড়নের মুখে পড়ে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, পণ্যের মান হ্রাস, সেবায় বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি সমভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থায় আমরা খুব সহজেই একে বাজার অর্থনীতির উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হই। আরও বিপদের কথা হলো রাষ্ট্র যখন এই অবস্থাকে সমর্থন করে, ক্রেতা সাধারণ তখন হতাশায় প্রমাদ গুণে।
দৈনন্দিন জীবনে অপাংক্তেয় ও অশুভ শক্তিকে প্রতিদিন অসহায়ভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের মানুষকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ এখন জীবনধারার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অভ্যন্তরীণ ক্ষত ও অসহনীয় যন্ত্রণা। অসহায় মানুষ এর প্রতিকারের জন্য নিষ্ফল চেষ্টা করে বটে, তবে তাতে কোনো ফল পায় না। আবার তাতে কারো কিছু যায় আসেও না। অসহায়ত্ব দিনে দিনে বোঝা হয়ে সমাজে গ্লানিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এভাবেই রাজনীতি ও সুশাসনের বিকৃত রূপের মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মানুষ ভোক্তা অধিকার হারিয়ে লাচার হয়ে পড়েছেন।
সাধারণ মানুষ ভোক্তা অধিকার হারালে সমাজে তার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভোক্তাগণ সমাজের অংশ। সমাজ টিকে থাকে তাদের কর্ম, চিন্তা ও দর্শনের দিয়ে। তাদের উৎপাদিত পণ্য, সেবা ও চেতনা বর্তমান ও ভবিষ্যত সময়ের প্রধান উপকরণ হিসেবে সমাজ পরিচালনা করে। ফলে ভোক্তাদের দুর্ভোগ সমাজে ক্রমসঞ্চিত নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। যা এক কাল থেকে অন্য কালে হেঁটে যায় - ইতিহাসে একে মন্দ ঘটনা বলে উদ্ধৃত করা হয়।
আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণীত হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পণ্যের মোড়কীকরণ না করা, মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রয় করা, ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা, খাদ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মেশানো, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, ওজন ও পরিমাপে কারচুপি, নকল পণ্য প্রস্তুত, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়, সেবাগ্রহীতার জীবন ও নিরাপত্তা বিপন্ন করা এবং সর্বোপরি কোনো সেবা প্রদানকারী অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো শান্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আরো কতগুলি বিষয় যেমন পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং মূল্য বৃদ্ধির রূপরেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষোক্ত এই দুটি বিষয় নির্ধারণের ব্যর্থতায় ভোক্তা অধিকার সম্যকভাবে কার্যকর হচ্ছে না।
এবার পর্যটনের দিকে নজর দেওয়া যাক। পর্যটনের প্রধান ভোক্তা পর্যটক। একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে কিছুটা সময়ের জন্য পর্যটকগণ ভ্রমণে যান। ওই সময় তাদের প্রয়োজন পড়ে জীবনমুখী নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পণ্য ও সেবার। যাপিত জীবনের একটা অংশে এরা ভ্রমণ করেন; আগ্রহী হন বিশ্রাম, বিনোদন বা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা লাভের আশায়। এদের ভ্রমণকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে পর্যটন শিল্প আজ তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পের আকার ধারণ করেছে। বৈশ্বিক জিডিপির ১০% আসে পর্যটন থেকে, ১০% কাজও সৃষ্টি করেছে পর্যটন খাত। তাই পর্যটকদেরকে যত্ন করার দায়িত্ব স্থানীয় মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের। উল্লেখ্য যে, পর্যটক প্রধান ভোক্তা হলেও গন্তব্যে বসবাসকারী মানুষ, পর্যটন সেবাদানকারী ব্যক্তিবর্গ এমনকি ওই স্থানে যাওয়া অন্যান্য মানুষও তাদের ভোক্তা অধিকার থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হন। পর্যটনের জন্য অন্যদের অধিক মূল্যে পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে হয়, যার ফলে গন্তব্যের সুনাম নষ্ট হয়।
কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো পর্যটন স্থানগুলিতে গমনাগমনের যানবাহনের মূল্য, বিশেষত আকাশযানের মূল্য সারা পৃথিবীতিতেই নিয়ন্ত্রণহীন। জুয়া খেলার মতো বিমান ভাড়া নিয়ে চলে নানা ধরনের কারসাজি। কখন বাড়ে আর কখন কমে তা কেউ বলতে পারে না। কেউ নিয়ন্ত্রণও করে না। বৈশ্বিক এই অনুশীলন থেকে অন্যরা শিক্ষা লাভ করে অবশিষ্ট সেবা যেমন খাদ্য, আবাসন, দর্শনীয় স্থানের প্রবেশ মূল্য, বিনোদন মূল্য ইত্যাদি সবই প্রতিদিন মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়তে থাকে। এই অবস্থার জন্য ভ্রমণরত মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। ভ্রমণের সকল আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়ে যায়। ফলে পর্যটন ভোক্তাগণ নিত্যদিন তাদের ভোক্তা অধিকার হারান।
ভোক্তাগণ অধিকার হারালে কী হবে? এটি খুবই একটি সংবেদনশীল প্রশ্ন। আমরা হয়তো এর গভীরতায় প্রবেশ করতে চাই না। তবে বিষয়টি তলিয়ে দেখা দরকার বলেই আমার ধারণা। নিচে এর একটি তুলনামূলক উপসংহার তুলে ধরছি।
প্রথমত, সাধারণ ভোক্তাগণ মূল্য বৃদ্ধি ও অন্য কোনো কারণে পণ্য ক্রয় বাধাগ্রস্ত হলে প্রয়োজনের তুলনায় কম পণ্য ভোগহ্রাস পদ্ধতিতে জীবন নির্বাহ করবেন। অনেকে কিছু পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করতে পারেন। কেউ কেউ পণ্য প্রতিস্থাপন কৌশলও বেছে নিতে পারেন। অর্থাৎ কৃচ্ছ্রতার আশ্রয় গ্রহণ করাই হবে ভোক্তাদের প্রধান চেষ্টা। এই চিত্রটি অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা দেবে এবং সমাজে অনাচারের জন্ম দিবে। নিম্ন আয়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ বাঁচার জন্য শ্রমের মূল্য বাড়াবে, যা আবার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সাধারণের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ না করতে করতে পারলে এই অনাচারের শিকার হতে হবে কমবেশি সকলকেই।
অন্যদিকে পর্যটন ভোক্তাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে একটি গন্তব্যে পর্যটন পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি ও মান হ্রাস হলে ভ্রমণকে আপদকাল হিসেবে বিবেচনা করে পর্যটনগণ বাধ্য হবেন পণ্য বা সেবা ক্রয় সংকোচন করে ভ্রমণ শেষ করতে। তবে পরবর্তীতে উক্ত গন্তব্যে গমনে অবশ্যই এরা বিমুখ হবে। এই বিমুখতা গন্তব্যের অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পর্যটকদের পরিমাণ হ্রাস পেলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মচ্যুতি ঘটবে। বিনিয়োগকারীগণ তাদের বিনিয়োগ নিয়ে বিপদে পড়বেন। ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ তুলে আনতে হিমশিম খেতে হবে। সর্বোপরি উক্ত গন্তব্য তার আয়ুষ্কাল দ্রুত হারাবে। যা গন্তব্যের বিনিয়োগকারীদেরকে ‘ট্যুরিজম রিফিউজি’তে পরিণত করতে পারে।
এই অবস্থায় আমাদের করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়ন জরুরি। পর্যটন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে অন্তত নিচের ৫টি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে প্রত্যক্ষভাবে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. পর্যটন আবাসন যেমন হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউজ ইত্যাদির খুচরা মূল্য ৯০ দিন পূর্বে ঘোষণা করতে হবে। করপোরেট রেট, বিশেষ মূল্য এবং বিজনেস টু বিজনেস মূল্য আলাদা ও অপ্রকাশিত থাকতে পারে।
২. গন্তব্যের যানবাহনের পরিবহণ মূল্য অন্তত ৩০ দিন পূর্বে নির্ধারণ করে ঘোষণা করতে হবে।
৩. খাদ্য মূল্য মান নির্ধারণসহ অন্তত ১৫ দিন পূর্বে ঘোষণা করতে হবে।
৪. স্থানীয় গাইডদের নামের তালিকা ও মূল্য ৯০ দিন পূর্বে ঘোষণা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, গাইড প্রশিক্ষণ ও মান অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়।
৫. গন্তব্যের স্থানীয় বাজার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যেন নিত্যপণ্য, স্যুভেনির ইত্যাদি কোনো কিছুই অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় না করতে পারে।
মোখলেছুর রহমান: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা
এসএন