আসল চিত্র পাওয়া যাবে চূড়ান্ত হিসাবে
পরিচালন মুনাফা আর নিট মুনাফা এক জিনিস নয়–এ দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সাধারণ মানুষ বা সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নাও থাকতে পারে। তবে যারা ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করেন তাদের এই বিষয়ে টনটনে জ্ঞান রয়েছে। এ কারণে তারা বেশি উল্লসিত হন না এবং এ নিয়ে তারা আমানতকারীদের সঙ্গে বেশি আলাপও করতে চান না; কিন্তু কোনো না কোনোভাবে পরিচালনা মুনাফা অর্জনের বিষয়টি মানুষ যেন জানতে পারে এ জন্য তারা বেশি উৎসাহ না দেখিয়ে সুক্ষ্মভাবে ‘নিউজ লিক’ করেন। এর কারণ কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন সাবেক ব্যাংক ব্যবসা পরিচালক এবং ব্যাংক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে জড়িতদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সাধারণ এবং ব্যাংকিং ব্যবসার মাঝে জড়িত মহলে একটা ধারণা দেওয়া যে, আলোচিত ব্যাংকটি ভালো, নৈপুণ্য দেখাচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো–ব্যাংকের ‘ইমেজ’ বা ভাবমূর্তিকে উন্নত করা বা রক্ষা করা। আরও অধিক সংখ্যক সাধারণ গ্রাহক বা আমানতকারীকে আলোচিত ব্যাংকের দিকে আকৃষ্ট করা, অর্থাৎ আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ বাড়ানো; যেসব ব্যাংক পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত ট্রেডিংয়ে সেগুলোর শেয়ার মূল্য কিছুটা হলেও যেন বৃদ্ধি পায় এবং আলোচিত ব্যাংকের একীভূত বা অধিগৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, মূল বিষয় হচ্ছে নিট মুনাফা কত হলো। পরিচালন মুনাফা থেকে বছর শেষে সরকারকে দেওয়া করপোরেট ট্যাক্স এবং ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের পর যে পরিমাণ টাকা থেকে যাবে বা উদ্বৃত্ত থাকবে, সেটিই হবে নিট মুনাফা। এই মুনাফার পরিমাণের উপর ভিত্তি করেই আলোচিত ব্যাংকের সফলতা, ইমেজ ইত্যাদি বাড়বে বা কমবে। নিট মুনাফার প্রধান ভাগীদাররা হচ্ছেন ব্যাংকের ডাইরেক্টর বা মালিকরা। ডিভিডেন্ট হিসাবে তারা লাভ পেয়ে থাকেন। সদ্য সমাপ্ত ইংরেজি বছরে বেসরকারি এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক ভালো পরিমাণে পরিচালন মুনাফা করেছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকও রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে–যেখানে বিগত বছরের একটি বিরাট অংশজুড়ে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল, সেখানে কীভাবে পরিচালন মুনাফার উল্লম্ফন ঘটল। এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলি লাভবান হয়েছে। তারা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরিচালন মুনাফা বাড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যংকের নির্দেশনার (সার্কুলার) আওতায় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন কম সংরক্ষণ করেছে, ঋণ আদায় না করেও তারা আদায় দেখিয়েছে (অর্থাৎ কৃত্রিম আয়) এবং বড় অংকের ডিভিডেন্ট দিতে যাচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো দূর্বল হয়ে পড়বে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা করোনা আপদকালীন সময়ে দেওয়া হয়েছে তার সবগুলোই বেসরকারি-বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই নির্দিষ্ট করেছিল।
চূড়ান্ত বিবেচনায় পরিচালন মুনাফা যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। দেশে অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা রয়েছে, যেগুলো প্রাথমিকভাবে সংস্থার পরিচালন মুনাফা দেখিয়েও চূড়ান্ত বা ফাইনাল অডিটে লোকসান দেখেছে। ব্যাংকিং সংস্থার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটতে পারে। ব্যাংকগুলো নিট মুনাফা কত পরিমাণে করেছে, তা জানা যাবে চূড়ান্ত হিসাবের পর। এর জন্য আরও দুই-তিন মাস সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। নিট মুনাফা কম হলে অথবা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি হয়তো বা প্রচারে সামনের কাতারে আসতে চাইবে না। তবে তারা উল্টোপথও ধরতে পারে। অর্থাৎ অধিকহারে প্রচারের দিকে মনোযোগী হতে পারে। তবে লাভ-লোকসান যা-ই হউক না কেন, ব্যাংক মালিকানায় যারা রয়েছেন চলমান পরিস্থিতিতে তারা লাভের ঘরেই থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক
এসএ/