কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের কথকতা
‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলা হতো অলিম্পককে, আর এখন ফুটবল বিশ্বকাপকেও। বলা হয়, ‘ফুটবল প্রায়শই একটি খেলার চেয়ে বেশি’। সপ্তাহখানেক আগে যবনিকাপাত হওয়া কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল তারই সাক্ষ্য বহন করে। আর এবার অবসান হলো আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার, একই সঙ্গে মেসিরও অব্যক্ত যন্ত্রণার।
আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার উচ্ছ্বাস আর ফ্রান্সের টানা দ্বিতীয়বার জিততে না পারার হাহাকার বিশ্বব্যাপী ফুটবল ভক্তদের মধ্যে মিলেমিশে একাকার। এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আর ভবিষ্যতের হিসেব নিকেশ। এদিকে হ্যাট্রিক সত্ত্বেও এমবাপ্পের প্রায় বাকরুদ্ধ হওয়া এবং ‘আবার ফিরে আসার’ অঙ্গীকারের নতুন দ্যোতনায় ভক্তরা উজ্জীবিত। ২০২৬ সালে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা’ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকবে এবারের স্মরণীয় সাফল্য এবং শ্বাসরুদ্ধকর ফাইন্যালের মৌতাত।
মেসিময় বিশ্ব, মেসি দেবতার উত্থান
ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার পর বিশ্ব এখন মেসিময়। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে মেসি বন্দনা চলছে। আর আর্জেন্টাইনদের কাছে মেসি তারও চেয়ে বেশি কিছু। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর পর ম্যারাডোনা আর্জেন্টাইনদের কাছে ’ফুটবল ঈশ্বর’-এ পরিণত হয়। ১৯৯৮ সালের ৩০ অক্টোবর ম্যারাডোনার ৩৮তম জন্মদিনে তার নামে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ম্যারাডোনার তিন পাঁড় ভক্ত ‘ইগলেসিয়া ম্যারাডোনিয়ানা’ বা ‘চার্চ অব ম্যারাডোনা’ নামে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এবার তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জয়ে মেসিকে আর্জেন্টাইনবাসী আরেক ফুটবল ইশ্বরের আসনে ইতোমধ্যে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছে। হয়ত ম্যারাডোনার মত কোনো মেসি গির্জাও প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত আসতে মেসিকে দীর্ঘদিন দেশের হয়ে ট্রফি না পাওয়ার অনেক যন্ত্রণা বয়ে চলতে হয়েছে।
মেসির বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ ছিল। প্রথম অভিযোগটি, মাত্র ১৩ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের জন্য স্পেনের বার্সেলোনায় চলে যাওয়া। যা তাকে পরবর্তীতে যতটা না ’লিও দ্য কাতালান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ততটা আর্জেন্টাইন হিসেবে নয়। দ্বিতীয়ত: ম্যারাডোনার মত নেতা না হওয়া। নেতা হওয়ার মত যোগ্যতা তার নেই—এমন অভিযোগে প্রায়শই বিদ্ধ হতে হয়। তৃতীয়ত: বার্সেলোনায় যত ট্রফি অর্জন করেছেন তার ছিটেফোঁটাও দেশের হয়ে করতে পারেননি।
আর এ সব অভিযোগ খণ্ডন করেছেন তার ভক্তরা। তাদের মতে, প্রথম অভিযোগটি একেবারেই অমূলক। অল্প বয়সে স্পেনে গেলেও দেশের প্রতি তার নাড়ির টানে কোনো ঘাটতি ছিল না। এক্ষেত্রে তার প্রতিভা জন্মভূমির প্রতি একটা নৈতিক ঋণ চাপিয়ে দিয়েছে নিজের উপর। বিশ্বকাপ জয়ের মধ্যে দিয়ে যার দায় থেকে মুক্ত হওয়া গেছে। নেতা হওয়া নিয়ে বলা যায়, মেসি এমনিতে কথা বলে কম। তার উপর নম্র, ভদ্র। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সে এবারের বিশ্বকাপে মেসি নিজেকে বদলে ফেলেন। নেতৃত্বের আগ্রাসী মেজাজেই তিনি বিশ্বকাপ জয় করেন। ২০২১ সালে মেসির নেতৃত্বে কোপা আমেরিকার জয় তাকে কিছুটা চাপমুক্ত করেছে। আর অভিযোগকারীদের থামিয়ে দিয়েছে যে, ‘সে ক্লাবের হয়ে যেভাবে খেলেছে সেভাবে আমাদের জন্য খেলেনি’।
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিবিসির একটি কলামে তার সতীর্থ পাবলো জাবালেতা লিখেছিলেন, ’মানুষ বিশ্বকাপে তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। মনে হয়, তাকে জিততেই হবে— সবসময়। অন্য কিছু গ্রহণযোগ্য নয়’। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে চুমু খাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে তিনি মানুষের অগাধ প্রত্যাশাকে আলিঙ্গন করতে পেরেছেন!
এবং আর্জেন্টিনায় সিক্ত বাংলাদেশ
আর্জেন্টিনাকে সমর্থনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এক নম্বরে। আর সেজন্য আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়সহ সাধারণ মানুষ বাংলাদেশকে নানাভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। বাংলাদেশের এই নিঃস্বার্থ সমর্থন ও ভালোবাসায় সিক্ত আর্জেন্টিনা এবার বাংলাদেশে দূতাবাস খুলতে যাচ্ছে। আমরা খুশী হব, যদি আর্জেন্টিনা তলানীতে থাকা বাংলাদেশের ফুটবলকে একটু সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর সময় বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সমর্থক প্রায় সমানে সমান ছিল। প্রথম পর্বের খেলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখে উভয় দেশের সমর্থকদের হৈ হুল্লোড়, মিছিল, খাওয়া দাওয়ার কমতি ছিল না। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোশিয়ার কাছে হেরে ব্রাজিলের অন্তর্ধানে একতরফা হয়ে যায় এই সব আয়োজন।
অবশ্য বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ব্রাজিল আর্জেন্টিার পতাকা উড়েনি। গাড়ি, বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনাতেও ছিল এই দুই দেশের লোগো, পতাকা ও খেলায়াড়দের ছবি টাঙানো। সকাল থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে, অফিস আদালতে, চায়ের দোকানে, অনুষ্ঠানে ছিল বিশ্বকাপের কথকতা। পাড়ায় মহল্লায় বড় পর্দায় খেলা দেখা, প্রিয় খেলোয়াড়দের পায়ে বল গেলেই টিভির আওয়াজের সাথে দর্শকদের উল্লাস। গোল হলেতো কথাই নেই, মধ্যরাতে গগনবিদারি চিৎকা্র, ভুভুজেলার আওয়াজে কান ঝালাপাল। চলে নানা ধরনের বাজি ধরা, খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজনও। সেই সঙ্গে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও তীর্যক মন্তব্য, একে অপরকে বিঁদ্ধ করার খেলা। যা অবশ্য বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরও চলছে।
তবে যে দিকটি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো কিছু কিছু তরুণের সৃজনশীলতা। ঘরে ঘরে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থনকে কেন্দ্র করে নানা টানাপোড়নের চিত্র হাস্যরসাত্মকভাবে তুলে ধরেছে তারা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায় তৈরি এইসব ভিডিও নাটক সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও হয়েছে। সৌখিন অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিয়ে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা বা ছোট ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে এ সব তৈরি। ভবিষ্যতে হয়তোএ তরুণদের কেউ কেউ তাদের সৃজনশীলতাকে নতুন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে।
ইব্রাহিম আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/