কুষ্টিয়ার ‘কুশলীবাসা শাহী মসজিদ’: মুঘল আমলের নন্দনশৈলীর নিদর্শন
স্থাপত্য ইতিহাস প্রকাশনায় ‘কুশলীবাসা শাহী মসজিদ’ কবে এবং কে তৈরি করেছেন, তার নিশ্চিত উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে, মুঘল আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত কুশলীবাসা গ্রামের আব্দুল খালেক মিয়ার বাড়ির আঙ্গিনায় অবস্থিত ‘কুশলীবাসা শাহী মসজিদ’। অদূরেই কালীগঙ্গা নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় প্রবাহিত।
গবেষকরা মনে করেন, মুঘল সম্রাট মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব (শাসনকাল ১৬৫৮-১৭০৭) তার শাসনামলে রাজকর্মচারী হিসেবে অনেককে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নদী পথে পাটজাত সোনালী আঁশ কেনা-বেচার দেওয়ানী দিয়ে পাঠাতেন। কর্মচারীদের অধিকাংশ ছিলেন সুফি মতাদর্শের ও ধর্মভীরু। তারাই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের আস্তানা তৈরি করে রাজকার্যের পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম প্রচারেও যত্নশীল ছিলেন। মুঘল আমলে নির্মিত ছোটো আকৃতির নন্দনশৈলীর মসজিদগুলো তাদের সেই সহমর্মিতার নিদর্শন বহন করে।
‘কুশলীবাসা শাহী মসজিদ’টি আওরঙ্গজেবের আমলের নির্মিত বলে ধারণা করা যায়। এই জাতীয় কর্মচারী ও ধর্ম প্রচারকদের অধিক সমাবেশ বাংলা অঞ্চলে লক্ষ্যণীয়, যারা সব ধর্মের মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হন। তাদের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ‘মানবধর্ম’ সমগ্র জনগোষ্ঠীকেই মুগ্ধ করতো।
মসজিদ স্থাপত্য (১২০৪-১৭৬৫) একটি কাঠামোগত ধারণা, যেখানে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা একসঙ্গে বা পৃথকভাবে তাদের নিত্যদিনের নামাজ আদায় করে থাকেন। প্রায় প্রত্যেক মসজিদ স্থাপত্যেরই একটি সাধারণ গাঠনিক রূপ থাকে। যেমন–মূল প্রার্থনা কক্ষ, ছাদের উপর স্থাপিত অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ, পিলার বা স্তম্ভের উপর ছোট মিনার-গম্বুজ এবং উঁচু মিনার। এ গঠনের ব্যতিক্রমও চোখে পড়ে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভূখণ্ডের মানুষের সংস্কৃতি, আবহাওয়া, ভূ-প্রকৃতি, শাসন কাঠামো, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি সকল দিকই সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের ধর্মীয় স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদের ধর্মীয় আয়োজন মেটানোর প্রয়োজনে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় পোড়ামাটির টেরাকোটা, চুন-সুঁড়কি, বিশেষ ধরনের মাটি পোড়ানো টালি। এসব উপকরণও নিজেদের মেধা বুদ্ধি দিয়ে ধর্মপ্রচারকগণ অথবা মুসলিম জমিদারগণ নির্মাণ করেন স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী নির্মাণশৈলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছোটখাটো বাস্তব উপযোগী মসজিদ যার মধ্যে স্থাপত্য কর্তৃত্বের ছাপ প্রতিফলিত হতো।
কুশলীবাসা শাহী মসজিদের গায়ে লতা-পাতার নকশা অঙ্কিত। মসজিদের মাঝে বড় গোলাকৃতি গম্বুজ একটি যার গায়ে লাগোয়া দুই পাশে লম্বা আকৃতির চারচালা ঘরের আদলে লম্বা ঢিবি আকৃতির দুটি গম্বুজ, যা একদমই ব্যতিক্রম। চারপাশে চারটি স্তম্ভ বা পিলারের উপর ছোটো আকৃতির মিনার যার উপর উল্টো করে টেপা কলস আকৃতির ছোটো গম্বুজ। বড় গম্বুজের উপর খাঁজকাটা নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী মিনার রয়েছে। মসজিদের দুটি দরজা একটি পূর্বদিকে অন্যটি উত্তরে। উত্তরের দরজার দৈর্ঘ্য ৪৬ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩৩ ইঞ্চি এবং দেয়ালের পুরুত্ব ১৮ ইঞ্চি। মসজিদের প্রবেশ দরজা এখন ভূমি সমতল থেকে ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় রয়েছে। ভেতরের দৈর্ঘ্য ১২ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। পশ্চিম দেয়ালে দুটি ও পূর্ব দেওয়ালে দুটি করে চারটি কোটর রয়েছে আলোক উৎস রাখার জন্য। মেহরাব দৈর্ঘ্যে ২ ফুট ৪ ইঞ্চি, উচ্চতায় ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং গভীরে ১ ফুট ৩ ইঞ্চি। উপর থেকে পরিমাপে দেখা গেছে, মসজিদের লম্বা ১৬ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১০ ফুট। মসজিদটি অন্তত ৫ ফুট মাটির নিচে চলে গেছে। এক কাতারের এই মসজিদে ৫ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ সংলগ্ন একটি ইন্দারা ছিল, যা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া আছে। ১৯৭৮ সালে (১৩৮৫ বঙ্গাব্দ) মসজিদের কয়েকটি অংশের মেরামত করা হয়।
মসজিদ নির্মাতার উত্তরাধিকার আব্দুল খালেক মিয়া জানান, তাদের পরিবার মসজিদের নামে ৫ শতক জায়গা ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ঐতিহ্য রক্ষায় মাঝে মাঝে তাদের পরিবার সমস্যার সম্মুখীন হন। শত প্রতিকূলতার মাঝে তার পরিবার এখনও মসজিদটি বাঁচিয়ে রেখেছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি কবর অবস্থিত। কবর সম্বন্ধে তাদের পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন যে, তিনি এমন একজন কামেল ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মসজিদের অভ্যন্তরে সার্বক্ষণিক ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। তার বেশ কিছু সহচরও ছিল বলে তিনি শুনেছেন। সুফি ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হলে তাকে মসজিদ আঙিনাতে দাফন করা হয় এবং সহচররা ভারতে ফিরে যান।
তাদের সংরক্ষিত পূর্বপুরুষ জামানার ছেঁড়া দলিল থেকে ‘একিন সা ফকির’ নামক একজনের নাম পাওয়া যায়। যার সঙ্গে মসজিদ নির্মাতার ঘনিষ্ঠতা অথবা ঘনিষ্ঠ উত্তরসূরি বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন মসজিদের সামনে ৬ কাতারের নতুন মসজিদ নির্মিত হয়েছে, যার প্রতি কাতারে ২৫ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। গবেষকদের ধারণা, ‘কুশলীবাসা শাহী মসজিদ’, যেখানে পাঁচজন মাত্র মুসল্লি নামাজের জন্য দাঁড়াতে পারেন–এমন ছোট আকারের মসজিদ কুষ্টিয়াসহ বাংলাদেশের কোথাও আছে কি না সন্দেহ!
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এসএ/