সমাবেশ, আতঙ্ক আর বিশেষ অভিযান
কী হবে ১০ ডিসেম্বরে, কী করবে জাতীয়তাবাদী দল আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, সরকার বিশেষ করে পুলিশের ভূমিকাই বা কী হবে? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা, উত্তেজনা আর জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যেকোনো আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে অথবা অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ বিষয়টা চলে আসছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবেই সারাদেশে সভা সমাবেশ চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমাবেশ করছে তাদের সাফল্য আর স্বপ্নের কথা প্রচার করার জন্য। বিএনপি সমাবেশ করে তাদের উপর নিপীড়ন, মামলা হামলা, তাদের নেতার মুক্তি, দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কথা বলছে। বামপন্থীদের জোট ও বাসদ, সিপিবি সমাবেশ করে ব্যাখ্যা করছে দেশের সংকটের কারণ এবং জনগণকে আহ্বান করছে বিকল্প চিন্তা এবং শক্তিগড়ে তোলার জন্য। রাজনীতিতে এরকম একটা পরিবেশই তো কাম্য। কিন্তু সরকার ও পুলিশের ভূমিকা সবার ক্ষেত্রে একরকম থাকছে না। কারো ক্ষেত্রে পুলিশি বাধা, কারো ক্ষেত্রে পরিবহন বন্ধ আর কারো ক্ষেত্রে পুলিশের সর্বাত্মক সহযোগিতা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে, তৈরি করেছে নিরপেক্ষতা সম্পর্কে অনাস্থা।
এরকম এক পরিবেশে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে নানা টানাপোড়েন। সমাবেশের স্থান নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা আর চলছে বিতণ্ডা।
যেটিই হোক, একটি সমঝোতা হবে, হয়ে যাবে— একথা বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর তার জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বল তো ওনার কোর্টে। উনি (ওবায়দুল কাদের) কী সমঝোতা করবেন, সেটা উনিই বলবেন। আমরা তো বলেছি নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে চাই। তারা আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সেখানে করব না।’ ফলে বল যার কোর্টেই থাক খেলা নিয়ে উত্তেজনা কিন্তু কমছে না। কারণ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের তারা নয়া পল্টনে অনুমতি দেবে না। আমরা তো বলেছি—আপনারা কী চান, বিকল্প কী দেবেন, আপনারা দিন। আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাব না। তারা নয়া পল্টনে দেবে না, তো কোন মাঠ দেবে, দাও। গ্রহণযোগ্য হলে আমরা নেব। ১০ ডিসেম্বর আমরা গণসমাবেশ করব।’
বিএনপির ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১২ অক্টোবর বিএনপির প্রথম বিভাগীয় সমাবেশ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ময়মনসিংহ থেকে প্রতিটি সমাবেশের আগের দিনই বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে কেউ কেউ চিড়া-মুড়ি, বিছানাপত্র নিয়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছিল। পত্রপত্রিকায় তা ফলাও প্রচার পেয়েছে। ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করেও তাদের সেরকম প্রস্তুতির আশঙ্কা করেছিল ক্ষমতাসীন দল। এটা বিবেচনায় রেখেই যে সমস্ত কথা শোনা যাচ্ছে যা থেকে মনে হচ্ছে যে, ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ যেখানেই হোক না কেন, আগের দিন থেকে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ দেবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্য ঢাকার মেস, হোটেল ও মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়েছে। দেখা যাবে যে ১০ ডিসেম্বরের পূর্বে নয়াপল্টনসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি থাকবে। তা ছাড়া
পার্শ্ববর্তী জেলা এবং দূর থেকে যাতে নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ না দিতে পারে, এ জন্য ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে তিন-চার দিন আগে থেকেই কয়েক স্তরের নিরাপত্তাচৌকি বসানোর পরিকল্পনা আছে পুলিশের।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারাও বলেছেন, ঢাকা মহানগর, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে তাদের নেতা-কর্মীরা যেন সতর্ক পাহারায় থাকে। তবে অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো ঢাকাতেও পরিবহন বন্ধ হবে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়।
পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে পরিবহন ধর্মঘট ডাকার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে নির্দেশনা না এলেও আতঙ্ক, তল্লাশি—এসব কারণে ১০ ডিসেম্বরের আগে থেকেই যানবাহন চলাচল কমে যেতে পারে একথা ভাবছেন তারা।
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ১০ ডিসেম্বর অবশ্যই ঢাকায় সমাবেশ হবে একথা জোরের সঙ্গে বলছে বিএনপি নেতারা। তাদের নেতারা জোরের সঙ্গে বলছেন, এই সমাবেশ থেকে মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখবে। এরপর তারা নতুন কর্মসূচি নিয়ে আরও তীব্রভাবে মাঠে নামবে। জনগণের সরকার যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করবে।
১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশের স্থান নিয়ে এখনো বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। তবে নয়াপল্টন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে রাজধানীর আরামবাগ এলাকায় সমাবেশ করার নতুন প্রস্তাব এসেছে। এটা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলেও সংকট কাটবে বলে আশা করা কঠিন।
সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের আলোচনা চললেও কঠোর অবস্থান থেকে সরছে না সরকার। তারাও চাইছে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজধানী ঢাকাকে ‘অবরুদ্ধ’ করতে। এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা কার্যত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া হবে, যাতে কয়েক স্তরের বাধা ভেদ করে বিএনপির পক্ষে বড় জমায়েত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঢাকার সমাবেশ ঘিরে সরকারের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরাসরি মাঠে থাকবে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপি যাতে ঢাকায় সাংগঠনিক শক্তি ও জমায়েত দেখাতে না পারে। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হবে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ। বিষয়টি কি সরকার, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাথায় নেই?
এর মধ্যে শুরু হয়েছে ধরপাকড়। পুলিশ বলছে এসব রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু মানুষ কি তা ভাবছে? ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুসারে, বিশেষ অভিযানে গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় ২৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১ হাজার ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, ইতোমধ্যে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ১৫টি দেশ যৌথভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে তারা বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে এ দেশের সাফল্যকে আরও উৎসাহিত করতে আগ্রহী এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে।
এই বিবৃতি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।
বিবৃতিতে তারা বলেছে, আমরা মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়ন উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মৌলিক ভূমিকাকে তুলে ধরতে চাই। আমরা মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে সংরক্ষিত স্বাধীনতা উদযাপন করি এবং ঘোষণাপত্রে বর্ণিত বিভিন্ন অঙ্গীকারের মধ্যে স্বাধীন মত প্রকাশ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও নির্বাচন বিষয়ে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরি।’
‘অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, সমতা, নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুসরণীয় মূল্যবোধ ও নীতি হিসেবে আমরা গণতান্ত্রিক শাসনকে সমর্থন ও উৎসাহিত করি।’
জাতীয়ভাবে সহিংসতার আশঙ্কা, আন্তর্জাতিকভাবে শঙ্কা আর সমাবেশ নিয়ে মারমুখী অবস্থান দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে? গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে কি অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়ে যাচ্ছে না? নাকি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাটকীয়তা জিইয়ে রেখে সমাধানের পথ খুঁজছে উভয়পক্ষ? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)