ডিজিটাল কবিতার বারোয়ারি ও মুখোশধারী কবি
সোশ্যাল মিডিয়া, মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে বলা যায়। কারণে অকারণে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া চলার উপায় নেই। স্বাভাবিকভাবে এতে চারপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে শিল্প সাহিত্যের উপরও।
কবিতায় এখন ডিজিটাল যুগ শুরু হয়ে গেছে। এক সময় বলা হত, বিশ্ব জুড়ে কবিতার পাঠক কমে গেছে। কবিতার বই বিক্রিও কমে গেছে। এই অবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কবিতার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার কবিতা বা ডিজিটাল কবিতা প্রচলিত কবিতার চেয়ে কিছুটা আলাদা। আঙ্গিকে ছোট, সহজ বাক্যাবলী, কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। জাপানি হাইকু কবিতা ও লিমেরিকের সঙ্গে এর সাযুজ্য দেখা যায়। ডিজিটাল কবিরা ইনস্টাগ্রামে নিজের কবিতার স্নিপেটগুলোর ছবি, কখনো হাতের লেখা বা কালো-সাদা টাইপ করা কবিতা পোস্ট করে। আর সারা বিশ্বের ভক্তদের কাছ থেকে পায় হাজার হাজার লাইক।
আধুনিক, উত্তর আধুনিকতা পেরিয়ে ডিজিটাল যুগের কবিতা এখন পাশ্চাত্যে খুবই জনপ্রিয়। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটক, টাম্বলার, পিন্টারেস্ট, ইউটিউবে কবিতা লিখে বা পড়ে অনেকে রীতিমত সেলিব্রেটিতে পরিণত। বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের মত তাদের কেউ কেউ বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। তাদের স্বকণ্ঠে কবিতা শুনতে টিকেট কেটে অডিটোরিয়ামে ভীড়ও করেন ভক্তরা। ইনস্টাপয়েট, টিকটকপয়েট নামে অভিহিত এসব কবি বয়সে তরুণ। আর তাদের ভক্তদের বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী।
এর কারণ তরুণরা এখন ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠছে। আর এর মাধ্যমে সহজে নানা কবির কবিতার রস আস্বাদন করতে পারছে ও সারা বিশ্বের কবিদের সঙ্গে গড়ে উঠছে সরাসরি যোগাযোগ।
কোভিডের আগে থেকেই গত পাঁচ বছরে বেগবান হয়েছে অনলাইন কবিতার জোয়ার। এই ধারার কোনো কোনো জনপ্রিয় কবির ডিজিটাল কবিতার মুদ্রিত বইয়ের বিক্রিও অবিশ্বাস্য! আমাজনসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রকাশনী তাদের কবিতার বই প্রকাশ করে। গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খ্যাতনামা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়, তাদের অনেকের বই বেস্টসেলার। কারো কারো কবিতার দু’এক লাইন দিয়ে বিভিন্ন পণ্যও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে টি শার্ট, ক্যাপ, আংটি, লকেট, ব্রেসলেট, ওয়াইনসহ নানা কিছু।
কোনো কোনো ভক্ত পছন্দের কবিতার কোনো শব্দ বা বাক্য দিয়ে শরীরে আঁকে উল্কি বা ট্যাটু। ডিজিটাল কবিদের আয় উপার্জনও অনেক। অনেকে এ ধরনের কবিতা লেখা, পড়াকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় ইনস্টাপয়েট হচ্ছেন মুখোশধারী। তিনি তার চেহারা দেখান না, মাস্ক পড়ে থাকেন। জনপ্রিয়তার ঢেউ সত্বেও। কোনো কোনো সমালোচক এই ডিজিটাল কবিদের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তাদের মতে, তারা ক্লাসিক কবিদের মর্মার্থ ধার করে লেখে। তারা এ সবকে ফ্যাশনাবেল বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে এই ধারাই একদিন কবিতার মূল ধারা হয়ে যাবে!
রূপি কৌর
ডিজিটাল কবিদের মধ্যে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়, সুপারস্টার রূপি কৌর। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয় নাগরিক। ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন অ্যাপে ৩০ বছর বয়সী রূপি কৌরের ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তিনি একাধারে কবি ও অঙ্কন শিল্পী। তার প্রতিটি কবিতার অলংকরণ করেন তিনি নিজেই। তিনি এমনভাবে কবিতা পড়েন, মনে হয় কবিতার অভিনয় করছেন। ইউটিউবে তার অসংখ্য ভিডিও আছে। এখন তিনি কবিতা নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে আছেন। তার কবিতা পাঠ দেখা ও শোনার জন্য ভক্তরা অগ্রিম টিকেট কেটে অপেক্ষা করেন। এর আগে তিনি ২০১৮ সালে ভারত সফরে কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লী, জয়পুরে কবিতা পাঠসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মার্কিন সাময়িকী, ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’ ২০১৯ সালে তাকে ‘দশকের লেখক’ হিসেবে অভিহিত করে। তিনি অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক, নারীত্ব, যৌনতাসহ জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেন এবং পোস্ট করেন। রিপাবলিকের মতে, তিনি প্রযুক্তি ও কাব্যিক কৌশলের সাথে তার শ্লোক, অঙ্কন ও ফটোগ্রাফকে ভালোভাবে ব্যবহার করেন।
গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলিং লেখক রূপি কৌরের এ পর্যন্ত চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালে ২১ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতার বই ‘মিল্ক অ্যান্ড হানি’ প্রকাশিত হয়। এরপর প্রকাশিত হয় ‘দ্য সান অ্যান্ড হার ফ্লাওয়ারস’ এবং ‘হোম বডি। চলতি বছরে সর্বশেষ ‘হিলিং থ্রু ওয়ার্ডস’ বইটি প্রকাশিত হয়। তার সব বই সারা বিশ্বে বেস্টসেলারের তালিকায়। তার কবিতার বই ১১ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি ও ৪৩টির বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। হ্যারিপটার চলচ্চিত্রের বৃটিশ অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন রূপি কৌরের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। এতে উঠে এসেছে কবিতার প্রতি ভালোবাসার আখ্যান।
ল্যাং লিভ
কবি ও উপন্যাসিক ল্যাং লিভ। থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে তার জন্ম। কম্বোডিয়া বংশোদ্ভূত ল্যাং লিভ অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে উঠেন, এখন থাকেন নিউজিল্যান্ডে। ইনস্টাপয়েট হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও সেলিব্রেটি। ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন অ্যাপে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ৮ লাখের বেশি। ২০১৩ সালে ল্যাং লিভ তার প্রথম কবিতার বই ‘লাভ অ্যান্ড মিস্যাডভেঞ্চার’ প্রকাশ করার পর তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর দু’বছর পর ফিলিপাইনে তিনি যান কবিতা পাঠ ও ভক্তদের সঙ্গে দেখা করতে। সে সময় অত্যধিক ভীড়ের কারণে প্রতিটি সেশনে ভক্তদের অটোগ্রাফ দেওয়া ৫০০ জনে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছিল। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করে। এমনকি কেউ কেউ রাতভরও। ভীড় সামলাতে আয়োজকদের সশস্ত্র রক্ষীদেরও সাহায্য নিতে হয়েছিল।
ল্যাং লিভের এ পর্যন্ত ১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে ৮টি কবিতার বই, ৪টি উপন্যাস। ‘লাভ অ্যান্ড মিস্যাডভেঞ্চার’ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতি মাসে ১০ হাজার কপি বিক্রি হয়। গত তিন বছরে তার বইগুলো ৩ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
‘লাভ অ্যান্ড মিস্যাডভেঞ্চার’ আমাজনে প্রেমের কবিতার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম যে আমি বই লিখে কিছু করব। তবে তিনটি বই আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারে থাকাটা— আমার স্বপ্নের বাইরে চলে গেছে।’ তাকে নিয়ে সিএনএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ডকুমেন্টারি, ফিচার প্রচার করেছে।
অ্যাটিকাস
সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ইনস্টাপয়েট ‘অ্যাটিকাস’। ছদ্মনামের কবি। তার জন্ম কানাডায়। এখন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার কবিতার বই ‘দ্য ডার্ক বিটুইন স্টারস’ এবং ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ম্যাজিক’ নিইউয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার। একাকীত্ব, প্রেম, সম্পর্ক, রোমাঞ্চকর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কবিতা লিখে পোস্ট করেন। জনসমক্ষে সব সময় মুখে মাস্ক পরে থাকেন। তিনি তার আসল পরিচয় দিতে চান না। তিনি বলেন, তার কবিতাই তার আসল পরিচয়। অ্যাটিকাসের কবিতা খুব ছোট। প্রতিটি ৫০ শব্দের বেশি হয় না। অ্যাটিকাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় উল্কি বা ট্যাটু করার লাইনটি হলো, ‘Love her, but leave her wild.’
২০১৩ সাল থেকে অ্যাটিকাসের লেখালেখি শুরু। এ পর্যন্ত তার ৫টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন অ্যাপে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এমা রবার্টস, কার্লি ক্লস, অ্যালিসিয়া কিস, কোডি সিম্পসনসহ হলিউডের অনেক সেলিব্রেটিও তার ভক্ত। তবে অ্যাটিকাসের কবিতা নিয়ে আছে বিতর্কও। লেখক ও সমালোচক কলিন ইয়োস্ট তার ইনস্টাগ্রামে অ্যাটিকাসের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তুলে প্রমাণও পোস্ট করেন। তার অভিযোগ, অ্যাটিকাসের বেশির ভাগ উদ্ধৃতিই টি ই লরেন্স ও অস্কার ওয়াইল্ডের মত। তারপরও অ্যাটিকাসের জনপ্রিয়তা কমেনি। আর তার ব্যবসা বুদ্ধিও প্রখর। অ্যাটিকাস নামে একটি সপ স্টোর অ্যাপ আছে। সেখান থেকে তার কবিতার শব্দ, লাইন বা অটোগ্রাফসহ বিভিন্ন পণ্য কেনা যায়।
এ ছাড়াও নিকিতা গিল, নারিয়াহ ওয়াহিদ, টাইলার নট গ্রেগসন, রবার্ট এম ড্রেক, অ্যালিসন মালি, ব্রায়ান বিলস্টনসহ আরও অনেকে ইনস্টাপয়েট হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মূলধারার অনেক কবিও এখন এভাবে কবিতা ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা শুরু করেছেন। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এই ধারায় বাংলা কবিতাও আরও বিকশিত হবে—এমনটা আশা করাই যায়।
লেখক: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/