কবি ও কাক সমাচার
কাক। কালো কুচকুচে, কুৎচিত। পাখিদের মধ্যে বোধ হয় সবচেয়ে অজনপ্রিয়। কাকের কা কা কর্কশ শব্দ কারো পছন্দ নয়। কাককে দেখতে হয় না। কাকই সবসময় চোখের সামনে চলে আসে। শহরে ময়লা আবর্জনা সহজলভ্য হওয়ায় অলিতে গলিতে কাকের পোয়াবারো। তো, এই হেন কাকের সঙ্গে কবিদের তুলনা? বলা হয়, ‘বাংলাদেশে কাক ও কবির সংখ্যা সমান’। কবে, কখন, কে, কোন পরিস্থিতে এই কথাটি উচ্চারণ করেছিল, তা হন্যে হয়ে খুঁজেও জানা যায়নি। অনুমান করা যায়, কাকের বিরক্তিকর অধিক উপস্থিতির কারণে শ্লেষাত্মকভাবে কবিদের জুড়ে দেওয়া হয়েছে! এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল।
‘একদিন আকবর ও বীরবল বসে গল্প করছিলেন। হঠাৎ আকবর প্রশ্ন করলেন, ‘দিল্লি শহরে কত কাক আছে বলতে পার বীরবল?’ অদ্ভূত প্রশ্নটি শুনে বীরবল বললেন, ‘জাঁহাপনা, বর্তমান শহরে ৯ লাখ ৯ হাজার ৯৯৯টি কাক আছে। আপনার যদি সন্দেহ হয় তাহলে নিজে অথবা অন্য লোক দিয়ে গুণে দেখতে পারেন। যদি দেখেন, এই সংখ্যা থেকে কিছু কম কাক আছে তাহলে বুঝবেন দিল্লির আশপাশে বন্ধুদের সঙ্গে তারা বেড়াতে গেছে। আবার যদি দেখেন ওই সংখ্যা থেকে বেশি কাক আছে, তাহলে বুঝবেন তাদের বন্ধুরা বা আত্মীয়রা অন্য এলাকা থেকে বেড়াতে এসেছে!’
ঢাকা বা বাংলাদেশে কাকের সংখ্যাইবা কতো—জানা থাকলে কবির জনসংখ্যা বোঝা যেত! তবে কবি তারাপদ রায় লিখেছেন,
‘ঢাকা খুব পুরোনো শহর।
সেখানে অনেক কবি, কবিতে কবিতে অন্ধকার ঢাকা।
ছোট কবি, বড় কবি, তত-বড়-নয় কবি
হলেও -বা-হতে পারতো কবি
আগে-পিছে, ডাইনে-বায়ে সেখানে কেবল
কবি আর কবি।
সেখানে কবি ছাড়া আরো যে দু’চারজন আছে
তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই কবির বন্ধু
কিংবা কবির শ্যালক।’
এই চিত্র শুধু ঢাকার নয়, সারা বাংলাদেশের। সব জায়গায় কবিদের নানা গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠীও। কে বড় কবি, কে ছোট কবি, কে কবি নয় তা নিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদও আছে। আচ্ছা, কেন কবি হওয়ার সাধ জাগে? কবিতা লেখা কি খুব সহজ? এলোমেলো কিছু লিখে দিলেই কি কবিতা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়? প্রকরণগত সুবিধার জন্যই কি কবিতার লেখক বেশি? যেখানে গল্প, উপন্যাস বা অন্য কিছু লিখতে যথেষ্ট ধৈর্য ও সময় লাগে।
আরও একটা কথা বলা হয়, বাঙালি হচ্ছে আবেগপ্রবণ জাতি। তাই প্রায় প্রতিটি বাঙালিই জীবনের কোনো এক সময় কবিতা লেখার চেষ্টা করে। আবার অনেকে বলেন, কবির সংখ্যা বেশি হলে বা সবাই কবিতা লিখলেই বা ক্ষতি কি? তারাতো আর দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি বা অস্থিরতা তৈরি করছে না। স্রেফ কবিতা লিখে নিজের আত্মসুখ বা প্রচারসুখ বা খ্যাতি অনুভব করার চেষ্টা করছে বা শখ পূরণ করছে।
সেজন্যই সারাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারিতে সবচে’ বেশি ছাপা হয় কবিতার বই। আর সবচে’ বেশি অবিক্রিত থাকে কবিতার বই-ই। বাংলা একাডেমির বই মেলায়ও অনেক কবিতার বই প্রকাশ পায়। এর মধ্যে বেশিরভাগ কবিতার বই জন্ম নেয় স্বউদ্যোগে বা স্বখরচে। প্রবাসীদের অনেকেও এভাবে কবিতার বই প্রকাশ করে নামিদামি প্রকাশনী থেকে। আর মেলায় এইসব কবিরা প্রতিদিন উপস্থিত থেকে চেষ্টা করে পরিচিতজনদের গছিয়ে দিতে! সেজন্য অনেকে ভয়ে আর মেলামুখোও হন না।
এর বাইরে, কবিতা লিখে প্রাপ্তিযোগেরও সুযোগ আছে। রাষ্ট্রীয়সহ নানা পুরস্কার জুটাতে পারলে সমাজে মান সম্মানের উন্নতি হয়। তাইতো অনেকে এর অপব্যবহার করতেও পিছপা হন না। ২০২২ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য উপ সচিব মো. আছাদুজ্জামান তার বাবা আমির হামজাকে বিশিষ্ট ‘কবি’ হিসেবে অভিহিত করে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। তবে অখ্যাত এই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাতিল করা হয়। এর আগে ২০২০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকের জন্য জনৈক রইজ উদ্দিনকে মনোনীত করা হলেও পরে সমালোচনার মুখে প্রত্যাহার করা হয়।
সেনা শাসক এরশাদেরও কবি হওয়ার সাধ জেগেছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে তল্পিবাহকদের নিয়ে কবিতাকে প্রায় কুক্ষিগত করে রাখে। সেনা কবির সঙ্গীসাথীদের রাজকীয় কবির অভিধাও জুটেছিল। সেজন্যই কিনা কবি মোহাম্মদ রফিক লিখেছেন,
‘সব শালা কবি হবে;
পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;
বন থেকে দাঁতাল শুয়োর
রাজাসনে বসবেই;’
(খোলা কবিতা)
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার আর্দশ রাষ্ট্র বা কল্পিত রাষ্ট্রে কবি-কবিতাকে বাদ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা আছে। তবে এখন তা চিন্তাই করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেকে ২২ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী কবি আমান্ডা গোরম্যান ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ কবিতা পড়ে শুনিয়েছেন। এতেই বুঝা যায় আধুনিক যুগে কবি ও কবিতার গুরুত্ব। আন্দোলন, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম-ভালোবাসায় কবিতা হয়ে উঠে অন্যতম শক্তি ও প্রেরণার উৎস— এটি আর নতুন করে বলার কিছু নেই।
এক্ষেত্রে কবি ও কাকের সমতুল্যের বিষয়টির কি হবে? তবে কাকের মধ্যে সৌন্দর্য ও ইতিবাচক দিকও আছে। ময়লা আবর্জনা সাবাড় করে কাক মানুষের উপকারই করে। কাকের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে ১৯টির বেশি বাগধারা। কয়েকটি যেমন, কাকচক্ষ—পরিষ্কার স্বচ্ছ জল, তীর্থের কাক— কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা, কাকের ভূষণ্ডি—দীর্ঘজীবী ব্যক্তি, কাকনিদ্রা— অগভীর নিদ্রা। আর কোনো পাখি নিয়ে এত বাগধারা আছে কিনা জানা নেই।
হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘কাক বেশ চমৎকার পাখি এবং আমার বেশ পছন্দ। অন্য পাখির দিকে তাকালে মনে হয় ওরা নিজেদের ছাড়া আর কিছু বোঝে না, ওরা মনে করে পৃথিবীটা ওদের জন্যই বানানো হয়েছে। কিন্তু কাককে দেখলে তা মনে হয় না। কাকই একমাত্র পাখি যেটি মানুষের সঙ্গে সক্রিয় সম্পর্কে জড়িত। কাক জানে পৃথিবীটা মানুষের অধিকারে। আর কোনো পাখি এসে দরজায় দাঁড়ায়, মানুষের সঙ্গে একটু খাবার ভাগাভাগি করে নিতে চায়?’ জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন,
‘সুন্দর করুন পাখা পড়ে আছে— দেখি আমি; চুপে থেমে থাকি
আকাশে কমলা রঙ উঠে সন্ধ্যায় কাকগুলো নীল মনে হয়’ (একদিন পৃথিবীর পথে)
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘কাক ডাকে’ কবিতায় আছে কর্কশ স্বরের স্নিগ্ধ রূপ:
‘কোথায় কাদের ছাদে সমস্ত দুপুর
কাক ডাকে শুনি।
বোঝা আর বোঝাবার
প্রাণান্ত ক্লান্তির শেষে
অকস্মাৎ খুলে যায় আশ্চর্য কবাট।
কাক ডাকে, আর
সে শব্দের ধু ধু করা অপার বিস্তার
হৃদয়ে ছড়ায় সব শব্দের অতীত
ধ্যান-গাঢ় প্রশান্তির মত’
মনে হয় বাংলাদেশে কবি ও কাকের প্রসঙ্গটি কখনো মুছে যাবে না। মান সম্পন্ন কবিতার বই প্রকাশই এর একমাত্র সমাধান হতে পারে। এখন কবিরা নিজ খরচে যেভাবে কবিতার বই গণহারে প্রকাশ করে, তাতে শুধু প্রকাশকরাই লাভবান হয়। তবে এই অগণিত কবি কবিতার মধ্যে প্রকৃত কবি ও কবিতার বিষয়ে বহু আগেই জীবনান্দ দাশ রক্ষাকবচ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। অর্থাৎ কবিতা লিখলেই কেউ কবি হয়ে যায় না!
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক
এসএন/আরএ/