দারিদ্র্যের একটি ‘নারী’ চেহারা আছে
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তখন আমাদের একটা উদ্দেশ্য ছিল–সাম্যের সমাজ গঠন করা। একটি ইনইকুয়াল সোসাইটি থেকে ইকুয়াল সোসাইটির দিকে যাওয়া। আজ পঞ্চাশ বছর পর এসে দুর্ভাগ্যের কথা হলো–আমরা সেই বৈষম্য তো কমাতে পারিনি, বরং এখন বৈষম্যের হার অনেক বেড়ে গেছে। সেটি কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন–উভয় ক্ষেত্রেই একটি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে এবং পেছন দিকে টানার আশঙ্কা আছে। তার কারণ হলো–আমি যদি মনে করি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে, সেখানে অবশ্যই সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রত্যেক নাগরিক যদি সমান সুবিধা ভোগ না করে, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি কিন্তু অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই সামাজিক ইকুয়ালিটি নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেন পেছনে পড়ে না থাকে। সবাইকে আমাদের সমান অধিকারের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে এবং তাদের জন্য সমান অধিকারের জায়গাটি তৈরি করতে হবে। কাজেই সমাজের মধ্যে এই বৈষম্য বাড়তে থাকা আমাদের অর্জনের মধ্যে অসম্পূর্ণতার কালো ছায়া ফেলছে।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই পথের দিকেই যাচ্ছি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এক সুতায় বাধা। আমাদের আরও একটি লক্ষ্য ছিল–সামাজিক ন্যায় বিচার, সমঅধিকার, আত্মসম্মানবোধ। এই জায়গাটিতে আমরা বুকে হাত দিয়ে দাবি করতে পারিনি যে, আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। একইভাবে মানুষের জন্য হিউম্যান ডিগনিটির জায়গাটা নিশ্চিত করতে পারিনি।
আমরা যে জায়গাগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করতে পারিনি, সেই জায়গাগুলোতে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ঘরে ফিরে আসার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। কাজেই ঘাটতিগুলোকে যদি আমরা অভ্যন্তরীণ ঘাটতি হিসেবে দেখতে চাই, তার বাইরের যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, বাইরে থেকে যে অনুরণন হচ্ছে, সেটিও কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি।
যদি একটা আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, যদি একটি দায়িত্বশীল বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমরা যদি সবার জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাহলে সামাজিক ন্যায়বিচার, হিউম্যান ডিগনিটি, বৈষম্যহীন এবং গণতান্ত্রিক সমাজের কোনো বিকল্প নেই।
অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যদি বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যোগাযোগ বৃদ্ধিতে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে আমরা নারীর ক্ষমতায়নের গল্পটা খুব বলি। বাংলাদেশের একটি অর্জনের জায়গা হিসেবে আমরা নারী ক্ষমতায়নকে তুলে আনছি।
গত পঞ্চাশ বছরে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। সেটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্য কোনো ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে সার্বিকভাবে নারীদের সমমূল্যায়নের জায়গাটিতে কিন্তু আমাদের ঘাটতি আছে। সেকারণেই নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, সহিংসতা এখনও কমছে না, বরং বাড়ছে। সেই বাস্তবতার প্রতিফলনই আমরা বহির্বিশ্বে দেখতে পাই। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টে নারী নির্যাতনের চিত্রটা আমদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
নারীরা তাদের যে সমঅধিকারের জায়গা, এমনকি কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য যে সামনে আরও সুযোগ তৈরি করা দরকার, একজন মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি যে সম্মানটুকু দেখানো দরকার–সেই জায়গাগুলোতে আমরা এখনও পর্যন্ত ঘাটতিতে পড়ে আছি। সেই কথাটিও কিন্তু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত।
আরও একটি বিষয় হলো–আমাদের এখনও ২০ শতাংশের মতো মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। আমরা ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে এটি ২০ শতাংশে নামিয়েছি। এই ২০ শতাংশের মধ্যেও কিন্তু নারীদের অংশ বেশি। দারিদ্র্যের একটি ‘নারী’ চেহারা আছে। কাজেই আমরা যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছি, সেখানে দারিদ্র্যের সঙ্গেও যে এটির সম্পর্ক আছে, সেটি আমাদের মনে রাখতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
এসএ/