সমাবেশ, পরিবহন ধর্মঘট ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেন নষ্ট না হয় সেকথা সবাই মানবেন। কিন্তু একদল বিভাগীয় সমাবেশ ডাকে আর সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ধর্মঘট হয়ে যাচ্ছে এটি কোন ধরনের সংস্কৃতি। একেকটা বিভাগে ৮টা জেলা, বিভাগীয় সমাবেশে জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা আসবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট হলে তারা আসবে কীভাবে? এ যেন বাচ্চাদের ছায়ার সঙ্গে দৌড়ানোর মতো।
সুকুমার রায়ের ভাষায়, ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ে গাত্রে হলো ব্যাথা। ছায়াকে ধরতে পারে না কিন্তু ক্লান্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হতে থাকে ক্রমাগত। তেমনি কি রাজনীতিতেও চলছে? একপক্ষ সমাবেশ ডাকে তো অন্যদের ইশারায় পরিবহন ধর্মঘট। এ নিয়ে চলছে বিতর্ক। ওরা আগে করেছে তখন দোষ হয়নি তাহলে আমরা করলে দোষ হবে কেন? কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে তার কৌশল চলছে। তবে কৌশল যাই হোক আর যেই করুক শেষ পর্যন্ত ঘাড়টা জনগণের এবং বোঝাটা বহন করতে হবে তাদেরই। সে বোঝা দুর্ভোগের, ভাড়া বৃদ্ধির, দ্রব্যমূল্যের অথবা পুলিশি হয়রানির আরও অনেক কিছুর।
একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে সামনে রেখে পরিবহন ধর্মঘট হচ্ছে প্রতিটি বিভাগে। মালিক সমিতি কি ধর্মঘট আহ্বান করতে পারে কিংবা শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট আহ্বান করলে কী নিয়ম অনুসরণ করতে হয়- তা নিয়ে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে ধর্মঘট হবে, বাস বন্ধ থাকবে এবং ময়মনসিংহ, খুলনার ধারাবাহিকতায় রংপুরের পর বরিশালেও ধর্মঘট হবে। মালিক সমিতির কেউ কেউ বলছেন কেন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে তা তো জানেন, তাহলে প্রশ্ন করেন কেন? ধর্মঘট আহ্বানকারীদের দাবিগুলো দেখলে বুঝা যায় এ হলো স্থায়ী দাবিতে অস্থায়ী কর্মসূচি।
তারা বলেছে, মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল বন্ধ করতে হবে। এদের কারণে দুর্ঘটনা হয়, বাস মালিকরা যাত্রী পান না। ফলে এসব বন্ধ করতে হবে। যদি কেউ বলেন একই দাবিতে ধর্মঘটের আহ্বান একটি বিশেষ দলের কর্মসূচির সময়েই কেন বারবার ডাকা হচ্ছে, সারাবছর কেন ডাকা হয় না? তাহলে কি সমাবেশ ও ধর্মঘটের মধ্যে যোগসূত্র আছে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সবসময়ই জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে এই ধর্মঘটের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ঐক্য আছে কিন্তু সম্পর্ক নেই। কী অদ্ভুত সম্পর্কহীন ঐক্য!
বাস মালিক সমিতির নেতারা তাদের ভয়াবহ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নাকি ধর্মঘট করছে। জিজ্ঞাসা হতে পারে, এই দাবিতে আগে তারা কী কী কর্মসূচি পালন করেছেন, সেক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল সে সম্পর্কে অবশ্য কিছু জানা যায়নি এবং আন্দোলনকারীরা নিজেরাও তা উল্লেখ করেননি। যেকোনো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে কিছু আন্দোলন তো করতে হয়। সে রকম কোনো আন্দোলনের খবর কেউ জানেন কি না তা জানা নেই।
স্বাভাবিকভাবেই সমাবেশ আয়োজনকারীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের গণসমাবেশে মানুষের স্রোত ঠেকাতে এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পরিবহনসংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, তাদের কিছু দাবিদাওয়া ছিল, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের জন্য তারা সরকারকে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত যানবাহন বন্ধ করে ‘আন্দোলন’ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে দুঃখজনকভাবে তাদের এই আন্দোলন কাকতালীয়ভাবে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সমাবেশের আগের দিন থেকে সমাবেশের পরের দিন পর্যন্ত পড়ে গেছে। কী আর করা! উপায়হীন বেদনা প্রকাশ।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বাসমালিকেরা কেন খুলনার বাস বন্ধ রেখেছেন, সে বিষয়ে তারা আমাদের অফিশিয়ালি কিছু জানাননি। কোনো দাবিদাওয়াও উপস্থাপন করা হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে জানি না। এর পাশাপাশি লঞ্চ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকেরা। এখন কী অবস্থা তাদের আন্দোলনের, তা জানতে অনেকের কৌতূহল জেগে উঠা অসম্ভব নয়।
সরকার একবার ঘোষণা করেছিলেন জরুরি প্রয়োজনে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, পরিবহনসহ যেকোনো সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা’ ঘোষণা করতে পারবেন। ‘অত্যাবশ্যক’ ঘোষণার পর সেখানে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকতে পারবে না, এমন কী মালিকরাও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারবে না। এই ঘোষণা না মানলে দণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এই আইন অমান্য করলে দণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, কেউ ধর্মঘট করলে তাকে বরখাস্তসহ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন ভাঙলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা ৬ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। মালিক ভাঙলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে। কেউ আইন ভাঙতে প্ররোচিত করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একদিকে করোনা অভিঘাত, অন্যদিকে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন টালমাটাল তখন বাস-ট্রেন-লঞ্চ বন্ধ করে রাখা কি অর্থনীতির জন্য বিরাট ধাক্কা নয়? ধর্মঘট যদি আইনসম্মত না হয় তাহলে বেআইনি এই ধর্মঘটের জন্য কাউকে কি জরিমানা করা হবে?
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে একথা সবাই বলেন কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশের সময়েই পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা যে ঘটেই চলেছে তা দেশের মানুষকে কী বার্তা দেবে? দলীয় কর্মী দিয়ে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তারসহ ক্ষমতায় থাকলে সব রকমে নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর এই সংস্কৃতির অবসান কি হবে? অতীতেও বিরোধী দলের কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে গাড়ি, ফেরি বন্ধের নানা নজির আছে। সেই খারাপ নজিরগুলোই কি বর্তমানেও চর্চা হতে থাকবে?
এসএন