ফুটবল বিশ্বকাপ সমর্থনেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ক্রিকেটে মনোকষ্ট
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাসীর দুঃখ কষ্টের শেষ নেই। এর মাঝে সবাই আগামী কিছুদিন খেলার আনন্দে মাতবে। অস্ট্রেলিয়ায় ইতোমধ্যে চলছে টি-টোয়ন্টি বিশ্বকাপ। শেষ হচ্ছে ১৩ নভেম্বর। বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলের উন্মাদনা বেশি। ফুটবল খেলে বিশ্বের সব দেশ। আর ক্রিকেট খেলে গুটিকয়েক দেশ। ফুটবলে না পারলেও ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলতে পারছে—এটাই ভালো লাগার বিষয়!
কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে ২০ নভেম্বর। শেষ হবে বা ফাইন্যাল হবে ১৮ ডিসেম্বর। ফুটবল বিশ্বকাপের উত্তাপের আঁচ লেগেছে আমাদের দেশেও। বিভিন্ন জায়গায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার ভক্তরা চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। দলবদ্ধ হয়ে বড় পর্দায় খেলা দেখা, উপাদেয় খানাপিনাসহ নানা আয়োজনের পরিকল্পনায় ব্যস্ত তারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভবনে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকাও উড়ছে। প্রতিযোগিতা শুরু হলে অন্যদেশের সমর্থকরাও মাঠে নামবে। ভবনে ভবনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর পতাকায় সয়লাব হবে। পতাকার দৈর্ঘ্যও বড় করে কেউ কেউ তাক লাগিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার জার্সি, স্টিকার বেচা কেনার ধুম পরে যাবে। আর ব্যবসায়ীরা এখন তা প্রস্তুত ও মজুত করতে শুরু করেছে।
তবে এতকিছুর মধ্যে শঙ্কা লোডশেডিং নিয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রায় সব খেলা হবে রাত ৯টা, ১০টা ও ১টার দিকে। কিছু খেলা আছে বিকাল ৪টা ও সন্ধ্যা ৭টায়। পিক আওয়ারেই খেলা বেশি হওয়ায় সবাই একযোগে খেলা দেখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। লোডশেডিং কখন কোন এলাকায় হয় তা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। অনেকে এজন্য জেনারেটারের ব্যবস্থাও করছে।
বিশ্বকাপ নিয়ে এদেশের লোকজনের আনন্দ উচ্ছ্বাসের তুলনা নেই! ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা জার্মানির সমর্থকদের আবেগেরও যেন শেষ নেই। ওই সব দেশের সমর্থকদের চেয়ে কম কিছু নয়, এদেশে থাকা তাদের সমর্থকদের। এখানকার কোনো কোনো ভবন ওই সব দেশের পতাকার রঙে সজ্জিত করা হয়ে থাকে। আমাদের ফুটবলাররা বিশ্বকাপে খেলতে না পারুক, মনে হয় এদেশের ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা জার্মানির সমর্থকরা সমর্থনের দিক দিয়ে সত্যিকারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!
কিন্তু আমাদের দেশের ফুটবলের অবস্থা কি? যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে! ক্লাব ফুটবলে আশির দশকে আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় যেরকম উন্মাদনা থাকত— তা কি এখন আছে? বিশ্বকাপ প্রাক বাছাইয়ে অঞ্চলভিত্তিক যে সব দেশের সঙ্গে খেলা হয়ে থাকে, সেসব খেলায় একই ফলাফল চলে আসছে। অর্থাৎ পরাজয়, পরাজয়। উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই! এখনও সাফ-এর গন্ডি পেরোতে পারেনি। সেখানেও সাফল্য মাত্র একবার। ১৩টি সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ২০০৩ সালে প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে! তারপর থেকে নিয়মিত অংশগ্রহণই মুখ্য ঘটনা।
অপরদিকে, মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতা হয় ৬টি। এর মধ্যে চলতি বছরের (২০২২) ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশ নেপালকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে প্রথম শিরোপা অর্জন করে। বাংলাদেশ দলকে বিমানবন্দর থেকে খোলা গাড়িতে করে শহর ঘুরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
এবার ক্রিকেট প্রসঙ্গে। বাংলাদেশসহ গুটিকয়েক দেশের খেলা হলেও সম্প্রতি ক্রিকেটের পরিধি বাড়ছে। নতুন আরও অনেক দেশ যুক্ত হচ্ছে। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। তবে ক্রিকেটের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সাফল্য নেই বললেই চলে। বিশ্বকাপ দূরে থাক, এখনো টি-টোয়েন্টি বা একদিনের এশিয়া কাপ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে মোট তিনবার রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট আছে! তবে মেয়েরা ২০১৮ সালে একবার এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে।
এখন মাঠে, খালি জায়গায় বা গলি পথে ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলাও চলে। সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের তরুণরা একদিন বিশ্বজয় করবে—এমন আশা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই! আর এখানে বিশ্বকাপ ফুটবল ছাড়া সারা বছরই ক্রিকেটের উন্মাদনাই বেশি। একটু জয় পেলেই মাতোয়ারা হয়ে উঠে। ক্রিকেটে চার, ছক্কা ও উইকেট পরে গেলে মুহূর্তে মুহূর্তে হাততালিতো আছেই। তারকাখ্যাতি, আয় সব মিলিয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া প্রায় সব ক্রিকেটারই সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়। এখানকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ফুটবলারের চেয়ে ক্রিকেটাররাই বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বলা যায়।
ফুটবল-ক্রিকেট প্রসঙ্গে বিখ্যাত ক্রিকেট সাহিত্যিক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ‘রমনীয় ক্রিকেট’ উপখ্যানে লিখেছেন,
‘… ফুটবল। ক্রিকেটের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। ফুটবল সারা পৃথিবীর। জনপ্রিয়তায় ক্রিকেটেরও অগ্রগণ্য। ফুটবল মাতোয়ারা করে তোলে। ফুটবল আগুন ছোটায়। খেলোয়াড়দের পায়ে আর গায়ে আগুন। সেই আগুন দর্শকদের বদনে ও বপুতে।
পাঠক! এমন অগ্নিকাণ্ড ঘটায় যে খেলা তাকে খেলার রাজা বলবেন?
অন্যের নিন্দে থাক। বিপক্ষের বদগুণ অপেক্ষা স্বপক্ষের সদগুণের আলোচনায় বেশি ফললাভ। ক্রিকেট মহান খেলা কারণ ক্রিকেটের সাহিত্য আছে। সাহিত্যের মূলে থাকে জীবন। খেলার সাহিত্য যদি একমাত্র ক্রিকেটের থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ক্রিকেটই সবচেয়ে জীবনময় খেলা।
ফুটবলের চেয়েও? যে ফুটবল দমবন্ধ দৌড়ে প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করছে আমি বেঁচে আছি। হ্যঁ। জীবন বলতে গেলে উত্তেজনা বুঝায় না। জীবন অনেক ব্যাপক। উত্তেজনা, আবেগ ও শান্তির নানারূপী বিন্যাস সেখানে। জীবনের আছে সূচনা ও সমাপ্তি। উভয়ের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনের তরঙ্গগতি। ক্রিকেট সেই খেলা। ক্রিকেট জীবনের ক্রীড়া-সংরক্ষণ’।
লেখক: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/