২০২৩: অশনি সংকেত
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪৩ সালে (১৩৫০ বঙ্গাব্দে) বাংলায় মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষের চালচিত্র ছিল এর প্রেক্ষাপট। এ উপন্যাস বা ছবিতে উঠে এসেছে এর ভয়াবহতা, অন্তর্বেদনা ও তৎকালীন গ্রাম বাংলার আর্থ-সামজিক অবস্থা। এখানে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশমুখী খাদ্যবাহী জাহাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে নেওয়ায়। কিউবার কাছে পাট বিক্রির অজুহাতে তারা এই অমানবিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আর সেসব দুর্ভিক্ষের পেছনে ফসল উৎপাদনে ঘাটতি, অর্থনীতির বিপর্যয় ছাড়াও অন্যতম প্রধান কারণ যুদ্ধাবস্থা। জাতিসংঘের তথ্য মতে, সোমালিয়ায় চলমান যুদ্ধের কারণে সেখানে এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে।
এ ছাড়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অনেকগুলো দেশে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আশঙ্কা, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীও একটি কথা বলে বার বার সতর্ক করছেন, এদেশে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকট যাতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। পতিত জমি আবাদ করতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও নিত্য পণ্যের বাড়তি দাম। কম খেয়ে, কম ব্যয় করেও সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। তার উপর বিশ্ব্যাংকের মূল্যায়ন হচ্ছে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হবে, বেকারত্ব বাড়বে। তাতে অবস্থা আরও খারাপ হবে। এদেশের সাধারণ মানুষ এখনই কঠিন সময় পার করছে। আয় ব্যয়ের সামঞ্জস্য কোনো মতেই রাখতে পারছে না। ২০২৩ সাল আসতেও আর বেশি দেরি নেই। মাত্র দুই মাস পরেই আলোচিত এই নতুন বছর শুরু হবে। চাকরি থাকবে কিনা, প্রতিষ্ঠান ঠিকে থাকবে কি না- এরকম নানা অনিশ্চয়তায় সাধারণ মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষ আতঙ্কিত। অবশ্য অনেকের কাছে সামনের দিনগুলো দূরে থাক, এখনই প্রতিটি দিন যেন ‘পুলসিরাত’!
সংকট নিরসনে সরকারের নানা কর্মর্সূচির পাশাপাশি সামাজিকভাবেও সবাই সম্পৃক্ত হতে পারলে ভালো হয়। তুরস্কে কয়েকশো বছর আগে ওসমানিয়া আমলে একটি জনপ্রিয় প্রথা চালু ছিল। তাদের প্রধান খাদ্য রুটি। আর রুটির দোকানে একটি ঝুড়ি রাখা থাকত। যার সামর্থ্য আছে, সে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত রুটি কিনে তা ওই ঝুড়িতে রাখত। আর নিঃস্ব, দরিদ্ররা ওই ঝুড়ি থেকে বিনামূল্যে ওই রুটি নিয়ে যেত।
নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমাদের দেশেও এরকম কিছু উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে। বিভিন্ন দোকান বা রেস্টুরেন্টে খাজা বাবার ওরস বা মসজিদের দান বাক্স দেখা যায়। সে আদলে প্রতিটি নিত্য পণ্যের ও খাবার দোকানে কি সেরকম কিছু রাখা যায়? নিত্যপণ্য কেনাকাটার সময় যারা সামর্থ্যবান তারা কিছু কিনে সেখানে রাখবে। আর যাদের প্রয়োজন তারা সেখান থেকে তা নিয়ে যাবে।
তুরস্কের এই আদলে আমাদের এখানেও যেকোনো উদ্যোগ হয়নি তা নয়। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক জায়গায় পুরোনো কাপড়চোপড় রাখার জায়গা হয়েছে। যেখানে রাখা এসব কাপড় যে কেউ তার প্রয়োজনে নিয়ে যেতে পারে। ফরিদপুরে ‘অনুপ্রয়াস‘ নামে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এরকম একটি উদ্যোগ নেয়। করোনার দুর্যোগের সময় তারা অনেকগুলো দোকানে ‘খুশির ঝুড়ি’ নামে একটি ঝুড়ি রাখে। যেখানে সামর্থ্যবানরা ছাড়াও তারা নিজেরাও শুকনো খাবার ও নিত্যপণ্য কিনে রাখত। যেখান থেকে যে কেউ বিনা প্রশ্নে বিনামূল্যে তা নিয়ে যেত। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ’সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মাত্র ১০০ টাকায় পুরোনো ল্যাপটপসহ নানা সামগ্রি দেওয়ার কর্মসূচি চালু করেছে।
‘বিদ্যানন্দ’সহ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সারা বছরই বিভিন্ন স্থানে দুঃস্থদের খাবার বিতরণ করে। কিন্তু অনেকে তৈরি খাবার নিতে চায় না। তার বদলে তারা চাল, ডাল, তেলসহ খাবারের উপকরণ নিতে আগ্রহী। যাতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুমুঠো খেতে পারে। বর্তমান অবস্থায় নিম্নবিত্ত, বস্তিবাসীসহ ভাসমান মানুষের সাহায্যে- এরকম মানবিক উদ্যোগেরও প্রয়োজন। সারা দেশের পাড়া মহাল্লায় বিভিন্ন ক্লাবসহ যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে তারা এরকম কিছু করতে পারে। যাতে মানুষ স্বস্তি পায়। বেঁচে থাকার আশার আলো দেখে।
এ প্রসঙ্গে শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়ে।
’মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য
একটু সহনাভুতি কি
মানুষ পেতে পারে না ?
—— ও বন্ধু’
লেখক: সাংবাদিক
এসএন