তিস্তা: দিল্লির কূটনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকাকে ফের বেইজিংমুখী করতে পারে
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি কৌশলী বার্তা পাঠিয়েছেন। বস্তুত বহু প্রতীক্ষিত জলবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারতের উপর নির্ভর না করে বেজিংয়ের সহায়তায় একটি বহুমুখী তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, বেছে নিতে তাকে উৎসাহিত করেছেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল লালমনিরহাট জেলার তিস্তা ব্যারেজ এলাকা পরিদর্শন করে। তাদের সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রকাশক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনও। চীনা রাষ্ট্রদূত তার সফরের প্রথম দিনে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা এখানে নদী ড্রেজিংয়ের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে এসেছি। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা প্রকল্পের সময়সীমা নিশ্চিত করার জন্য পরিস্থিতি বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করছেন। আমরা নিশ্চিত যে, সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা সম্মত হলে তিস্তা মেগা প্রকল্প খুব শিগগিরই চালু হতে পারে।‘
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই প্রকল্পের ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের (যারা প্রাথমিকভাবে মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল) জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। লি বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বাসিন্দাদের সঙ্গে ওই এলাকায় কয়েকটি বৈঠক করেছেন।
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে তিনি তিস্তার জলবণ্টনের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। প্রতিশ্রুত ওই চুক্তিটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র বিরোধিতার কারণে ২০১১ সাল থেকে আটকে আছে।
আন্তঃসীমান্ত নদীর জলবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করতে মরিয়া ঢাকা। তিস্তা নদীর তীরে আনুমানিক ৯০,০০০ হেক্টর জমির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা গ্রীষ্মের সময় অব্যবহৃত থেকে যায়। কারণ সে সময় তিস্তায় ভয়ঙ্কর রকম জলের সঙ্কট দেখা যায়। উল্লেখ্য, ব্রহ্মপুত্রের উপনদী তিস্তা হিমবাহে উৎপন্ন হয়ে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপরে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার জনসমক্ষে বলেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত দ্রুততম সময়ে এই চুক্তিটি শেষ করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। পাশাপাশি বাংলাদেশও তার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলের সঙ্কট মোকাবিলায় বিকল্পগুলি খোঁজ করছে।
বহুল আলোচিত বহুমুখী তিস্তা নদী ব্যবস্থাপ প্রকল্পের মধ্যে থাকবে ডেজিং, জলাধার নির্মাণ, নদী তীরে একটি ব্যবস্থা স্থাপন এবং নদীর উভয় তীরে বাঁধ ও স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ। বাংলাদেশ সরকার প্রায়ই এই অঞ্চলের কৃষকদের সেচ চাহিদার সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হিসেবে প্রকল্পটিকে উল্লেখ করে থাকে।
উল্লেখ্য, দুই বছর আগে, ঢাকা চীনের অর্থ সাহায্যে ১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প রূপায়ণের প্রস্তাব করেছিল। কারণ ভারতের সঙ্গে চতুর্থ বৃহত্তম আন্তঃসীমান্ত তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি এক দশক দীর্ঘ অপেক্ষা করার পরেও কার্যকর করা যায়নি।
এত বড় প্রকল্পে চীনের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ভারতকে যে উদ্বিগ্ন করবে তা বলাই বাহুল্য। এর পাশাপাশি চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে হাইড্রো-কূটনীতির ব্যর্থতারও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেবে।
নিরাপত্তার দিক থেকে ভারতের কৌশলগত উদ্বেগও রয়েছে। এই প্রকল্প ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে 'চিকেনস নেকে'র কাছে। উত্তরবঙ্গের খুব কাছে চীনের উপস্থিতি ঘটাতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের এই অংশটি কার্যত উত্তর-পূর্বকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ঢাকার একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, প্রকল্প চীনের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে দিলির আপত্তির পর হাসিনা সরকার পরিকল্পনাটি কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে, গত মাসে শেখ হাসিনার সফরের সময় তিস্তার জলের বিষয়ে দিল্লির ব্যর্থতার পরে এই প্রকল্পে ঢাকার নতুন করে আগ্রহের প্রতিফলন হিসেবে চীনের রাষ্ট্রদূতের একটি প্রযুক্তিগত দলের ওই এলাকায় সফরকে দেখা যেতে পারে, ঢাকার একটি সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই এলাকায় রাষ্ট্রদূতের পরিদর্শন, জল উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক সরকারি অফিসারের উপস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে যে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে জলের ঘাটতির সমস্যা মোকাবিলায় চীনের সাহায্য নেওয়ার বিকল্পটি নিয়ে কাজ করতে করতে আগ্রহী ঢাকা। তিস্তা প্রকল্পের ফাইল ফের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে গেছে বলেও জল্পনা তুঙ্গে উঠেছে।
সূত্রের মতে, বাংলাদেশে জল যেহেতু একটি আবেগপ্রবণ ইস্যু তাই শেখ হাসিনা সরকার তিস্তা চুক্তির জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করার অবস্থায় নেই। বিশেষ করে যে সরকার আগামী বছর নির্বাচনের মুখোমুখি হবে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশের গবেষকরা তিস্তার শুকিয়ে যাওয়া, কৃষি অর্থনীতি এবং ওই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের ওপর তার প্রভাব নিয়ে সবিশেষ উদ্বিগ্ন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা বিষয়টির একটি দ্রুত সমাধান আবশ্যক।
বাংলাদেশের জলসম্পদ বিভাগের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম চীনা রাষ্ট্রদূতের সফর এবং প্রকল্পটি চালু করার ব্যাপারে তার মতামত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং হাসিনা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার চীনের টোপ গেলা নিয়ে জল্পনা করার সময় আসেনি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলারের বেশি খরচ হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খানিকটা চাপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই সময় এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাংলাদেশ বহন করতে পারে কিনা, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন।
বাংলাদেশ তার অর্থনীতির উপর ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে আইএমএফ-এর সঙ্গে সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার ঋণের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ২ বিলিয়ন ডলারও চেয়েছে।
আরেকটি সরকারি সূত্র অবশ্য মনে করে, গুরুত্বের তালিকায় একেবারে প্রথম দিকে থাকা তিস্তার জলচুক্তির বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা করতে তৎপর ঢাকা। সেক্ষেত্রে দিল্লির বার্থতার প্রসঙ্গ তুলে হাসিনা সরকারের কাছে বেজিংয়ের সাহায্য নেওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়নি তারা।
গত এক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বারবার এই চুক্তি সম্পাদনে বাধা দিয়েছেন আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন ও ন্যান্সি পাওয়েলের নির্দেশে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ যদি চীনের এই প্রস্তাব মেনে নেয়, তাহলে শুধু মমতাই নয়, নরেন্দ্র মোদির মুখের উপরেও যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক