মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয় নিবেদন
এই উপমহাদেশে রেলগাড়ির চাকা প্রথম ঘুরেছিল ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভারতবর্ষের বোরি বন্দর থেকে, পরে নাম হয় ভিক্টোরিয়া টার্মিনালস। সবশেষে স্টেশনটির নাম হয় ‘ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনালস’। এখন এটি বিশ্ব ঐতিহ্যর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যাত্রা শুরুর সময় একুশ বার তোপধ্বনি করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইঞ্জিনের নাম ফকল্যান্ড, বগি ১৪টি, আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ৪০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
পণ্য পরিবহনের সুবিধার্র্থে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ সেকশন ও ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে দর্শনা ও পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ সেকশনটিকে চালু করে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়ার ‘জগতি রেলওয়ে স্টেশন’ যা পূর্ব বাংলার সর্বপ্রথম রেলওয়ে স্টেশন। নদীমাতৃক এই গড়াই সভ্যতায় যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌকা, গরুগাড়ি, ঘোড়াগাড়ি, মষেরগাড়ি, পালকি, ঘোড়া ইত্যাদি- ঠিক তখনই ফকির লালন শাহ্ স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হলো রেলগাড়ি। জগতি স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নৌবন্দর, হাট-বাজার। এখান থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে পাট, আখের গুড়, আম, কাঁঠাল, সবজিসহ সরবরাহ হতে থাকে। গড়ে ওঠে নতুন এক রেলকেন্দ্রিক গড়াই সভ্যতা।
প্রমত্তা গড়াই নদীর উপর রেলসেতু ১৮৬৯ সালে তৈরি হবার পরে গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয় ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ১৮৭৩ সালে ভাষাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন লিখেছিলেন ‘গৌরি সেতু/গড়াই ব্রিজ কবিতা’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রেলপথ ধরেই ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম শিলাইদহে আসেন। ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৯ সালে ইশ্বরদীর সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত সেকশনটি নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে মিটারগেজে চালু হয়। ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে এবং ১ এপ্রিল ১৮৮৭ সালে তা নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সাথে একীভূত হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোড়াদহ-ভেড়ামারা, ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ ভেড়ামারা সেকশন, ১৯১৫ সালেই ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী এবং ১৯৩২ সালে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর সেকশনগুলো চালু করে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়।
ভারতবর্ষে ১৮৫৩ সালের প্রথম রেলগাড়ির স্টেশন ‘ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনালস’ বিশ্ব ঐতিহ্যর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ১৮৬২ সালের ‘পূর্ব বাংলায় প্রথম রেলওয়ে স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি’ আজ অযত্ন অবহেলায় ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে। জগতি স্টেশনে জমির পরিমান আনুমানিক ৩৫০ একরের অধিক, দূরত্ব কুষ্টিয়া শহর থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রথম ও পুরাতন স্টেশন হিসেবে উন্নয়নের ছোঁয়া একদমই লাগেনি, অথচ স্টেশনটি ঐতিহাসিক! বর্তমানে স্টেশনটি যুগ যুগ ধরে বন্ধের পথে এবং সরকারি জায়গাগুলোও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। স্টেশনের গা ঘেঁষে এখনো স্বদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে বাষ্পচালিত রেলগাড়ির ব্যবহৃত পানির ট্যাঙ্ক। ইতিহাসের স্বাক্ষী ‘জগতি স্টেশন’কে সংস্কার করে অনায়াসে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভবÑ যা দেখে নতুন প্রজন্ম আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে এবং বাংলাদেশের পর্যটন হবে আরও সমৃদ্ধ।
কুষ্টিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করতে যেয়ে জানতে পাই-পূর্ব বাংলার প্রথম জগতি রেলওয়ে স্টেশনে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। মানুষের জানা ও দেখার আগ্রহ প্রচুর। আমাদের জোর দাবি কুষ্টিয়াতে ‘বাংলাদেশে প্রথম রেলওয়ে স্টেশন জগতি’ পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করার। নতুন প্রজন্ম জানবে, দেখবে, বুঝবে; আর গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠবে।
‘আমাদের ঐতিহ্য আমরা বাঁচাতে চাই’।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক