হতদরিদ্রের পর্যটনতত্ত্ব
দারিদ্র্যকে কেবল অর্থনীতির মানদণ্ডে পরিমাপ করা উচিত নয়, এর বহুমুখী রূপ আছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, ধর্মীয় ও জৈবিক রূপের দারিদ্র্য আমাদের মধ্যে বিরাজমান। হত্যাযোগ্য দারিদ্র্যকে আমরা বলি হতদরিদ্র অর্থাৎ এটি দারিদ্র্যের হন্তারক রূপ। এই হন্তারক দারিদ্র্যকে তাড়ানোর জন্য পৃথিবীতে খুব বেশি সংখ্যক মানুষ সাহস দেখায়নি। হয়তো পারা যাবে না বা টেকসই হবে না এই ভেবে কম সংখ্যক মানুষ এগিয়েছেন। নির্মোহভাবে স্বীকার করতেই হবে যে, দরিদ্র মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে শক্ত হয়ে থাকতে পেরেছেন এমন মানুষ বিরল। তাত্ত্বিকভাবে যা বলা যায় বাস্তবে তা থেকে ফল বের করে আনার পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন বৈকি!
পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, হতদরিদ্ররা ভঙ্গুর, অনড়, দৈহিক ও মানসিকভাবে দুর্বল, ভীতু, কম অভিজ্ঞ, অসুস্থ, স্বল্পবিত্ত, আত্মকেন্দ্রিক ও অযত্নশীল। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তীব্র প্রভাব এদেরকে এই অবস্থায় এনেছে। এদের দায় আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না। তবে এরা টিকে থাকার কৌশল অর্জন করেছে বলেই এদের অস্তিত্ব বিরাজমান। এই মানুষদের সংখ্যা সমাজে কমবেশি ১০ শতাংশ।
জনগোষ্ঠীর তলায় পড়ে থাকা ১০ শতাংশ মানুষকে বলা হয় বটম টেন পপুলেশন। এরা সমাজের দৃষ্টিতে অকর্মণ্য, তাই অসহায়। এদের ঋণ পাবার যোগ্যতা নেই। তাই এরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খায়। এরা যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে না, তাই সাধারণ উৎপাদন চক্রে এদের অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। কিন্তু এদের রয়েছে পোড় খাওয়া জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতা। এরা চেতনায় দৃঢ় ও বিবাদমুক্ত, অক্রিয়াশীল, অনড় ও অনৈক্যে আবদ্ধ। ফলে তথাকথিত নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় এনে এদেরকে ক্রিয়াশীল ও উৎপাদনশীল করা হয় না।
পালমা অনুপাতের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে হলে প্রথমে বটম টেন এপ্রোচের মাধ্যমে নিম্নতম স্তরের ১০ শতাংশ মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজে যুক্ত করতে হবে।
কমিউনিটিভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে এদেরকে ব্যষ্টিক অর্থনীতির সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুক্ত করা যাবে। কেবল উদবুদ্ধ করা, সামান্য আর্থিক সহযোগিতা বা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনে পালমা অনুপাত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এদের চোখে নতুন আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করে অনড়, অসাড় ও ভঙ্গুর বটম টেন পপুলেশনকে পর্যটনের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যকে অন্তত ৬ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা- চরম দারিদ্র্য, আপেক্ষিক দারিদ্র্য, অবস্থানগত দারিদ্র্য, সৃষ্ট দারিদ্র্য, গ্রামীণ দারিদ্র ও নাগরিক দারিদ্র। আমার বিবেচ্য প্রথমটি অর্থাৎ চরম দারিদ্র্য বা হতদরিদ্র।
১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাংক দৈনিক ১ মার্কিন ডলার আয়ের এবং ২০১৫ সালে ১ দশমিক ৯০ মার্কিন ডলার আয়ের মানুষদেরকে হতদরিদ্র বলে অভিহিত করে। তবে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর তার নিজস্ব দারিদ্র সীমারেখার উপর এই শ্রেণি নির্ধারণ নির্ভর করে।
তবে কেবল আয় নয়, হতদরিদ্ররা খাদ্যাভাব, পানীয় জলের অভাব, চিকিৎসা, আশ্রয়, শিক্ষা, তথ্য এমনকি সামাজিক অধিকার ও বিচার থেকে বঞ্চিত। দুঃখায়ুতে অর্থাৎ দুঃখসমৃদ্ধ আয়ুতে মোড়ানো এসব মানুষেরা সমাজের বোঝা হয়ে প্রতিনিয়ত সংকট সৃষ্টি করেই চলছে। কেবল পর্যটন পারে এদেরকে এই অনিশ্চয়তা থেকে বের করে আনতে।
পর্যটন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম খাত এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পখাত হলেও এতে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ অপর্যাপ্ত। বিনিয়োগ, দক্ষতা, ব্যবসায়িক কৌশল, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রথাগত সীমাবদ্ধতার জন্য এই শিল্পে এদের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত।
পর্যটন পৃথিবীতে দাপুটে শিল্প হয়েছে কর্পোরেট সংস্কৃতির জন্য। শিক্ষক ও গবেষকরা এর সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে জুড়ে দেওয়ার কিছু কৌশল খুঁজছেন। কিন্তু তা খুব বেশি একটা কার্যকর হচ্ছে না। একাডেমিক ও গবেষণা উপাদান হিসেবে ভালো হলেও বাস্তবে দরিদ্র মানুষের জন্য তেমন একটা কাজে লাগছে না। বিশেষত হতদরিদ্ররা এর বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
সব ধরনের পর্যটন দারিদ্র্য বিমোচনের সূচনা করলেও পর্যটন কতটা দারিদ্র্য বিমোচন করেছে এটি এখনো বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। তবে দরিদ্র মানুষদেরকে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করে বেশ কিছু সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরা কোন স্তরের দরিদ্র। হতদরিদ্র মানুষকে তার দারিদ্র্য থেকে কী পরিমাণ মুক্তিই বা দিতে পারে।
লেখক: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ
এসজি