বইমেলা শুধুই বই বিপণন নয়, সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসবও
বইমেলা সারা পৃথিবীতে আজ শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসব হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বই বিপণনে বইমেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সারা বছরব্যাপী পৃথিবীতে যে সকল বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেগুলোকে তিনটি ধরনে ভাগ করা যায়। ক. প্রফেশনাল'স বুক ফেয়ার, খ. পাবলিক বুক ফেয়ার, গ. প্রফেশনাল অ্যান্ড পাবলিক বুক ফেয়ার।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। পাঁচ দিনব্যাপী এই বইমেলার প্রথম তিনদিন শুধুমাত্র প্রফেশনালরা অর্থাৎ প্রকাশক, রাইট এজেন্ট, লেখক, সাংবাদিক, কপিরাইট এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য মেলা সংরক্ষিত থাকে। মেলার শেষের দুইদিন জনসাধারণ প্রবেশ করতে পারেন, বইও কিনতে পারেন। লন্ডন বইমেলায় প্রথম দিন থেকেই প্রফেশনাল এবং পাবলিকের প্রবেশ অবাধ থাকে। রাইট বিক্রি এবং বই বিক্রি দুটোই প্রথম থেকে শেষদিন অবধি চলে। বোলোগনা, বুক এক্সপো আমেরিকা মূলত রাইট বিক্রির বইমেলা।
চীনের বাজারের জন্য বেইজিং, হংকং এবং তাইপেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রফেশনাল বুক ফেয়ার। মধ্যপ্রাচ্য, আবুধাবি, শারজাহ এবং দুবাই ক্রমশ রাইট বিক্রির বইমেলার কেন্দ্র হয়ে উঠছে সাম্প্রতিককালে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতেই বইমেলার ইভেন্ট বই বিপণনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বই বিপণন ছাড়াও বইমেলা বর্তমান পৃথিবীতে 'শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসব' হিসেবে স্বীকৃত। বইমেলায় বই বিক্রির পাশাপাশি প্রকাশনার সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেমিনার, প্যানেল ডিসকাশন, লেখক-প্রকাশক মিটস-আপ ইভেন্ট, নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশগ্রহণকারী সব মানুষকে অন্যরকম একটি মননশীল আকর্ষণের জগতে নিয়ে যায়, যার প্রয়োজন বেশ গুরুত্বপূর্ণ, অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশে ভাষার মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা ছাড়াও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে বছরব্যাপী সীমিত সংখ্যক বিভাগীয় ও জেলা শহরে বইমেলার আয়োজন করা হয়। তবে ইদানীং সমিতির উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি বেশি বইমেলার আয়োজন বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা সমিতি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজনে ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং কোলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় অংশগ্রহণ করছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহযোগিতায় কলকাতায় সিঙ্গেল কান্ট্রি বুক ফেয়ার 'বাংলাদেশ বইমেলা' হচ্ছে। এ সবকিছুই অত্যন্ত ইতিবাচক দিক বাংলাদেশের বইয়ের বাজার সম্প্রসারণের জন্য। এখনো বাংলাদেশে বইয়ের যতটুকু জনপ্রিয়তা দেখছি, তা এ সব কার্যক্রমেরই ফসল। তবে বাংলাদেশ এবং কলকাতাসহ অন্যান্য দেশে আমাদের আয়োজিত সকল বইমেলাই পাবলিক বইমেলা। বইয়ের রাইট বিক্রির বিষয়টি এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বইয়ের রাইট বিক্রির বিশাল সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে রয়েছে। এজন্য বেশি বেশি আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ এবং দেশে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন প্রয়োজন।
শক্তিশালী রিডিং সোসাইটি গড়ার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে।
ক. মান সম্মত পান্ডুলিপি নির্বাচন করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে বইয়ের প্রকাশনা ও বিপণন নিশ্চিত করা।
খ. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে বছরে কমপক্ষে একবার সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন নিশ্চিত করা। দেশে-বিদেশে বইমেলার আয়জনের চর্চা বাড়াতে হবে।
গ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক পাঠাগার ব্যবস্থাপনা এবং সক্রিয় ও কার্যকর কার্যক্রম নিশ্চিত করা। প্রতি শ্রেণিকক্ষে বয়সভিত্তিক বই কর্নারের ব্যবস্থা করা।
ঘ. দেশের সরকারি-বেসরকারি পাঠাগারের প্রসার ও বিদ্যমান পাঠাগারের কার্যক্রম যুগোপযোগী ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ।
ঙ. দেশে পাঠ্যাভ্যাস আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত গবেষণা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় পাঠ্যাভ্যাস আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। এই সামাজিক আন্দোলনটিকে বেগবান করে লক্ষ্য অভিমুখে পৌঁছানোর বহুমাত্রিক কর্মসূচির একটি অন্যতম প্রধান হচ্ছে বইমেলা। বইমেলার আয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক আরও অনেক বেশি বেশি হওয়া প্রয়োজন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাৎসরিক সপ্তাহব্যাপী বইমেলা আয়োজন বাধ্যতামূলকভাবে করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশাপাশি সব শ্রেণিকক্ষে বয়সভিত্তিক ছোট বুক কর্নার থাকতে পারে। বছরে সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন থাকলে শিক্ষার্থীর উপর এর প্রভাব পড়বে সুদূরপ্রসারী। শিক্ষার্থী প্রতিবছর নতুন নতুন বইয়ের সঙ্গে খুব সহজে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তাদের প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, ক্লাসের বুক কর্নার এমনকি বাসায় ব্যক্তিগত লাইব্রেরিও প্রতিবছর প্রয়োজনীয় নতুন নতুন বইয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। সর্বোপরি বই সংগ্রহ ও পাঠের একটি প্রগতিমুখী সাংস্কৃতিক আবহ প্রজন্মের মননে গড়ে উঠতে থাকবে যা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে একটি সোনালী প্রজন্মের জন্ম দেবে। এই সোনালী প্রজন্মই মূলত বাঙালিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ উপহার দেবে। তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বইমেলা আয়োজনের চর্চা বেগবান করা আজ জরুরি।
লেখক: লেখক ও প্রকাশক
আরএ/