গণতন্ত্রের সংগ্রাম আর নিপীড়নের সংস্কৃতি
গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন কথা বলা, লেখা, সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা। মত প্রকাশ আর মত প্রচারের পর প্রয়োজন মতামত যাচাই করার স্বাধীনতা যা নির্বাচনের স্বাধীনতা হিসেবেও বলা যায়। কিন্তু নির্বাচনকে রাজনৈতিক মত প্রচার, যাচাই, গ্রহণ, বর্জনের পদ্ধতির চাইতেও ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক বিষয় গুরুত্বহীন হয়ে ক্ষমতা দখল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মানেই সংঘাত সংঘর্ষ উত্তেজনা।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দিন দিন। বিভিন্ন স্থানে সংঘাত আর আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। পত্রিকায় বড় বড় খবর আর পাঠক পড়ছেন সেসব ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। রাজপথে উত্তেজনা না থাকলে তা নাকি রাজনীতি বলে মনে হয় না। এমন কি টেলিভিশনের টক শোতেও উত্তেজনা না ছড়ালে নাকি তা মানুষ দেখতে চায় না। যুক্তিপূর্ণ কথার চাইতে অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক কথা উচ্চস্বরে বললে নাকি দর্শক শ্রোতাদের একটা বড় অংশ মনে করেন, দারুণ বলেছে, একেবারে প্রতিপক্ষকে শুইয়ে দিয়েছে। তর্কের মধ্যে মারমার কাটকাট ভাব থাকলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের দর্শক সংখ্যা এবং মতামত প্রদানের হার বাড়তে থাকে তর তর করে। দর্শক শ্রোতাদের এই ধরনের পছন্দের কারণ কি তা নিয়ে একটা গবেষণা হতে পারে এবং তা মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে সহায়তা করতে পারে কিন্তু এই মারমুখী ব্যাপারটা যে গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অনুকূল নয় সেটা অনুভব করছেন সবাই। অনেকসময় মূল বিষয়কে আড়াল করার জন্যও কৃত্রিম উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি করা হয়।
যে কারণে কোন রাজনৈতিক দল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কথা বলছে, একটি বড় জনসমাবেশ করেছে এটা কোনো খবর নয়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে, আহত নিহত হয়েছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমালোচনার ধরনটা সে রকমেরই। সরকারি দল বলতে থাকে,বিরোধীদের আন্দোলন করার সামর্থ্য নেই, জনগণ তাদের সঙ্গে নেই, এরকম আন্দোলন করে কিছু করতে পারবে না ইত্যাদি। এর ফলে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে তার কিছু নজির লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাজনীতিতে যুক্তি পাল্টা যুক্তি থাকবেই। থাকবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকা তখন কি রকম হবে? তারা কি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থাকবেন নাকি দলীয় কর্মীর মত ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। এর রাজনৈতিক সমাধান হয় নি বরং এই ধারনাটাই স্থায়ী হয়েছে যে, যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারা প্রশাসন ও পুলিশকে তাদের মত করেই ব্যবহার করবেন। ফলে ক্ষমতাসীনরা আন্দোলনকারীদেরকে পুলিশের ভয় দেখাবেন আর বিরোধীদল মোকাবিলা করবে পুলিশকে। পুলিশের ভূমিকা আর রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মনোভাব দুই ক্ষেত্রেই যখন মারমুখী অবস্থান তখন বিরোধীরা কিছু করতে পারেনা ক্ষমতাসীন দলের এ ধরনের বক্তব্য উস্কানির মত শোনায়। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পুলিশ নামে মাঠে, মারপিট করে, গুলি করে আবার মামলাও করে। এইসব মামলার প্রকৃতিটাও ভিন্ন। আসামি করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয় কর্মীরা। জেলে থাকে অথবা জামিন নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকে মাসের পর মাস। রাজনৈতিক বিরোধ পরিণত হয় রাজনৈতিক সহিংসতায় আর প্রতিহিংসাপরায়ণতায়।
হামলা-মামলা গ্রেপ্তারতো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় গুম হয়ে যাওয়ার ভয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে দেশে কোনো গুমের ঘটনা ঘটে না। কিন্তু বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে গুম হয় এবং তা আতঙ্ক তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যেমন আইন সালিস কেন্দ্র (আসক) তাদের এক জরিপে বলেছে, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদেরকে বিভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা তারা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। এইসব নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের বেশিরভাগ আর তাদের স্বজনদের কাছে ফিরে আসেনি। আসক এর মতে ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন, বাকিদের খবর জানা নেই। একটা বিষয় খুবই আশ্চর্যের যে যারা ফিরে এসেছেন তাদের কেউই বলছেন না যে কে তাদের আটকে রেখেছিল, তারা কোথায় ছিলেন এবং কীভাবে তারা ফিরে এলেন? একেবারে চুপচাপ হয়ে যান তারা।
এক্ষেত্রে আরও একটি ঘটনার কথা নিশ্চয়ই মানুষ ভুলে যায়নি। সন্ত্রাস দমনের নামে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালান হয়। এই অভিযানে ৫৯ জন মারা যান। হৃদরোগে তাদের মৃত্যু হয়েছিল বলে সে সময় যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। কিন্তু দেশের মানুষ তখন তা বিশ্বাস করেনি, এখনো যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোও মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিপীড়িত হওয়ার ভয়ের পরিবেশে গণতন্ত্র থাকে না। মামলার ভয়, অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় থাকার ভয়, বছরের পর বছর মামলার জের টানার ভয়, মরে যাওয়ার ভয়ের পাশাপাশি গুম হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তার চর্চা হবে কীভাবে? ভয় থেকে আত্মসমর্পণ বা বেপরোয়া হয়ে উঠা দু’ধরনের ঘটনাই ঘটতে পারে। আত্মসমর্পণে মর্যাদা নষ্ট হয় আর বেপরোয়া মনোভাবে বহুল কথিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্যতা পায়? সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাই হামলা, মামলা, গুম, খুনের আতঙ্কমুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণ করা প্রাথমিক শর্ত।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
আরএ/