বর্জ্য হতে পারে শক্তি ও সম্পদের প্রধান উৎস্য
পৃথিবীর নবম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার ঘণত্বের দিক থেকে দেশটির অবস্থান ১২তম। শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে। এখানে অন্যান্য অনেক সমস্যার চেয়ে বড় আকারে বাড়ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা। রাজধানী ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেক রকমের তথ্য রয়েছে। ধরা হয়, বাসযোগ্যতার অনুপযোগিতার দিক থেকে ঢাকা পৃথিবীর দশম শহর। এটি মাঝে মাঝে দুই এক এর মধ্যে চলে আসে। ঢাকা শহরের বর্জ্য স্থানান্তর বা বিন্যাসের কোনো সুব্যবস্থা নেই। অতি দুর্বল এখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
আমরা যদি দেশের বর্জ্যের দিকে তাকাই, তাহলে যে উপাত্ত পাই, তা হলো, প্রতি বছর কমবেশি ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন টন বর্জ্য জমছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই ১০ থেকে ১৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ জৈব বর্জ্য, ১৫ ভাগ অজৈব প্লাস্টিক বর্জ্য ও বাকি ১৫ ভাগ বিবিধ বর্জ্য। এই প্লাস্টিক বর্জ্যের্ ২০ ভাগ একবার ব্যবহৃত পলিথিন। এই পলিথিন এখন দেশের জন্য সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। ঢাকা সংলগ্ন নদী বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষা থেকে শুরু করে নগরীর সকল ড্রেনেজ, সূ্য়্যেরেজ ও কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে পলিথিনে।
ঢাকাসহ প্রধান প্রধান শহরের মিউনিসিপ্যাল আবর্জনা অপসারণের জন্য নির্ধারিত এলাকাগুলোর সংলগ্ন বিশাল আয়তন জুড়ে রোগ জীবানুর প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যেখান থেকে প্রতিনিয়ত এডিস মশা থেকে শুরু করে বহু রোগের জীবানু ছড়াচ্ছে। এসব আবর্জনাকেন্দ্রে ঢাকা শহরেরই শত শত টোকাই পলিথিন, প্লাস্টিকসহ নানা পণ্য সংগ্রহ করছে। তারাও প্রতিনিয়ত নানা জীবানু বহন করছে ও রোগ ছড়াচ্ছে।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে ঢাকা শহরের নাগরিক বর্জ্যের মধ্যে ১৫ ভাগ প্লাস্টিক আবর্জনা, ৬৫ ভাগ জৈব আবর্জনা ও ২০ ভাগ বিবিধ আবর্জনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচ, চামড়া, ধাতব পদার্থ, কাপড়, কাঠ ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো এসব আবর্জনার ব্যবস্থাপনা কী হতে পারে?
আমরা ওয়েস্ট টেকনোলজি এলএলসি ইউএসএর পক্ষ থেকে গত এক দশকে দেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি, নগর পরিকল্পনাবিদ এমনকি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। পৃথিবীর সর্বাধুনিকতম বর্জ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ বান্ধব সার্কুলার ইকোনমির ধারণা তাদের সামনে উপস্থাপন করেছি। আমরা পৃথিবীর অনেক দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, বিষয়টিতে তারা যথেষ্টই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে বরাবরই চেয়েছি আমাদের প্রযুক্তি ও কর্মতৎপরতার সুফল সর্বপ্রথম বাংলাদেশে পৌঁছাক, সেই লক্ষ্যে এখনো আমাদের প্রয়াস ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
নগরের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা দাতা সংস্থা, সিটি করপোরেশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সমন্বয় করে একটি অসাধারণ কর্মব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। যে ব্যবস্থার আওতায় গৃহস্থ বর্জ্য তথা নাগরিক বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা হবে, সেখান থেকে আরেকটি ইউনিটে বিভিন্ন উপাদান পৃথকীকরণ করা হবে। যেখান থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হবে ডিজেল, অ্যাভিয়েশন জ্বালানি ও এলপিজি। জ্বালানি থেকে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। জৈব আবর্জনা থেকে তৈরি হবে বায়োগ্যাস, উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে হবে জৈব সার, বায়োগ্যাস রূপান্তর করা হবে সিএনজিতে যা পরিবহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হবে, অন্যদিকে জৈব সার ব্যবহার হবে আবাদি জমিতে। একইভাবে সিটি করপোরেশনের অন্যান্য বিবিধ আবর্জনা কাঠ, কাঁচ, চামড়া, ধাতব পদার্থ বানিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রি হবে সংশ্লিষ্ট ইণ্ডাষ্ট্রিতে। এখানেই শেষ নয়, আবর্জনার যেসব অংশ থেকে জ্বালানী আসবে সেসব জ্বালানি থেকেই উৎপাদিত হবে বিদ্যুৎ। যা যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
কাঠের যুগ, পাথর যুগ, ধাতব যুগ পেরিয়ে আমরা এখন প্লাস্টিক যুগে বসবাস করছি। চারদিকে প্লাস্টিকে সয়লাব। এক হিসেবে দেখা যায়, পৃথিবীতে অশোধিত যে তেলের ভাণ্ডার তা মূলত ব্যবহার হয় একদিকে পরিবহন খাতের জ্বালানি বাবদ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। আরেকদিকে ব্যবহার হয়, মানুষের ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রি উৎপাদনে। আর প্লাস্টিক ব্যবহারের পরপরই পরিণত হয় বর্জ্যে। এটি সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ সমস্যা।
খোলা মাথায় একটু ভেবে দেখতে পারেন, প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে না কোথায়? আমরা শুধু প্লাস্টিক বোতলে পানি খাচ্ছি, ওষুধ খাচ্ছি বা ব্যাগে পণ্য বহন করছি তা-ই নয়, জীবনের প্রতিটি অংশে, এমনকি কৃষি ও পরিবেশের যত কাজ সেখানেও প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। আর এই প্লাস্টিক আমাদের জন্য হয়ে উঠছে এক বিভীষিকা। প্লাস্টিক কী কী ভাবে আমাদের এই সুন্দর ধরিত্রীকে তার নিজের ক্ষেত্রে পরিণত করছে তা দেখতে পারি।
এক. একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাগাড় দিনে দিনে বহু আয়তন দখল করে নিচ্ছে।
দুই. ব্যবহৃত প্লাস্টিক ভাগাড় পর্যন্ত পৌছতে অতিরিক্ত পরিবহনর প্রয়োজন হচ্ছে।
তিন. এসব ক্ষেত্রেও রয়েছে অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন।
চার. যেহেতু এগুলো মাটিতে মেশেনা সেহেতু পরিবেশে এর কঠিন নেতিবাচক প্রভাব তো বলাই বাহুল্য।
পাঁচ. এখান থেকে পানি দুষণ হচ্ছে।
ছয়. বাতাস দুষিত হচ্ছে।
সাত, আমাদের সামুদ্রিক জীবন দিনে দিনে বিপদজনক হয়ে উঠছে।
আট. দুষণে আক্রান্ত হচ্ছে নদ-নদী।
নয়. ড্রেনেজ ও সুয়েরেজ বন্ধ হয়ে একটু বৃষ্টিতেই বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে একেকটি শহর।
প্লাস্টিক কী?
প্লাস্টিক হচ্ছে ম্যাক্রোমোলিকিউলস, পলিমারাইজেশন দ্বারা গঠিত হয় যা যথার্থ পরিমাণে তাপ এবং চাপপ্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনও ধরনের শক্তির মাধ্যমে আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে।
প্লাস্টিকগুলো তাদের অর্থনৈতিক মূল্য, সহজ প্রাপ্যতা, সহজ প্রক্রিয়া ক্ষমতা, হালকা ওজন, স্থায়িত্ব এবং শক্তি দক্ষতার কারণে আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
প্লাস্টিক আধুনিক বিশ্বকে গড়ে ওঠার পেছনে এক নিয়ামক হয়ে উঠেছে। আমাদের জীবনযাত্রার মানকে রূপান্তরিত করেছে। এমন কোনো মানবিক ক্রিয়াকলাপ নেই যেখানে প্লাস্টিক পোশাক থেকে আশ্রয়, পরিবহন থেকে যোগাযোগ এবং বিনোদন থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না।
প্লাস্টিক কীভাবে তৈরি হয়
প্লাস্টিক কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন এবং অন্যান্য উপাদানের বিভিন্ন সংমিশ্রণ বা সমন্বয়ে গঠিত। এখন প্লাস্টিকের অগণিত রকমের ব্যবহার রয়েছে। কাঠ, বাঁশ. কাঁচ, চামড়া, রাবার, ও ধাতব পদার্থের জায়গা দখল করছে প্লাস্টিক।
প্লাস্টিকের উৎস্য
ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বেশিরভাগই নিম্নলিখিত রাসায়নিকগুলো থেকে উদ্ভূত হয়:
১. ইথিলিন, ২। প্রোপিলিন, ৩। বিউটাডিন এবং ৪। বেনজিন
এই রাসায়নিকগুলি প্রক্রিয়াকরণের পরে পেট্রোলিয়াম পরিশোধন প্রক্রিয়ার সময় বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে প্রাপ্ত ন্যাপথা থেকে উদ্ভূত হয়।
কত রকমের প্লাসটিক
থার্মো প্লাস্টিক ও থার্মোসেটিং প্লাস্টিকের মধ্যে দুটি ধরন আছে। একটি উচ্চতাপমাত্রায় আকৃতির পরিবর্তন হয়, আরেকটি উচ্চ তাপমাত্রায় আকৃতির পরিবর্তন হয় না।
থারমোপ্লাস্টিক থেকে পলিথিন, পলিপ্রোফিলিন, নাইলন, পলি কার্বোনেট ইত্যাদি হয়। এখান থেকেই বাকেট, কাপ, নাইলন রশি, দুধ ও পানির বোতল, কন্টেনার ইত্যাদি তৈরি হয়। অন্যদিকে থার্মোসেটিং প্লাস্টিক থেকে ফেনল ফর্মালডিহাইড, ইউরিয়া ফরমালডিহাইড, মেলামাইন ফর্মালডিহাইড, থার্মোসেটিং পলিয়েস্টার ইত্যাদি হয়। সেখান থেকে আমরা ইলেক্ট্রিক সুইচ, ফরমিকা সেমিকা টেবিল-টপ, মেলামাইন বাসন কোসন তৈরি হয়।
প্লাস্টিক ফিড স্টক রিসাইকেলিং বুক এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্লাস্টিক বর্জের ১০ ভাগ পুণর্ব্যবহার হয়, ২৫ ভাগ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং ৬৫ ভাগ ভাগাড়ে অথবা যত্র তত্র ফেলে দেয়া হয়। এগুলোই মাটিতে মেশে।
ওয়েস্ট টেকনোলজি এলএলসি ইউএসএ উদ্ভাবিত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে চাই। বর্জ্য প্লাস্টিক সংগ্রহ করে বাছাই, ধোয়া ও শুকানোর পর চুর্ণ করা হয়। সেগুলোকে উচ্চ তাপে গলানো হয়। সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ঘনত্বে ছেকে প্রক্রিয়াজাতকরণেল মাধ্যমে তৈরি কনরা হয় জ্বালানি। এই জ্বালানিই পরিশোধন করে বিমানের জ্বালানি ও এলপিজি করা হয়। ওই জ্বালানি থেকেই দহন ইঞ্জিন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়।
আমরা ওয়েস্ট টেকনোলজি এলএলসি ইউএসএ’র পক্ষ থেকে হিসেব কষে দেখেছি, বছরে ২৮ মিলিয়ন টন বর্জের ১৫ ভাগ যদি প্লাস্টিক বর্জ্য হয়, তাহলে তার পরিমাণ হবে ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন টন। এই পরিমাণ বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে ৫ হাজার ৪’শ ৬০ মিলিয়ন টন ডিজেল, ৪২ দশমিক ২ মিলিয়ন সিলিণ্ডার এলপিজি ও ৯৬. ৬ মিলিয়ন লিটার এভিয়েশন ফুয়েল বা গ্যাসোলিন পেতে পারি। যদি মোট বর্জ্য প্লাস্টিকের ভেতর থেকে ২ শতাংশ একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকও ব্যবহার করি তাহলে তা থেকে আমরা পাবো ১ হাজার ৪২ মিলিয়ন লিটার ডিজেল, ৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন সিলিণ্ডার এলপিজি এবং ১ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন লিটার এভিয়েশন ফুয়েল। এই জ্বালানি থেকে প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২ দশমিক ১ মেগাওয়াট। বছরে হবে ১ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মেগাওয়াট। এখানে কর্মসংস্থান হবে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষের।
বাংলাদেশে ২৮ মিলিয়ন টন কঠিন বর্জ্য জমে, বা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ২ মিলিয়ন টন জৈব বর্জ্য দিয়ে বছরে বিপুল পরিমাণ বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও জৈব সার পেতে পারি। এর পরিমাণটি বছরে ১৬৩ মিলিয়ন সিলিন্ডার বায়োগ্যাস, ৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন জৈব সার।
আমাদের প্রতিষ্ঠানে সুদীর্ঘকালের গবেষণা, জরীপ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ও শিল্প স্থাপন করে তা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে নিশ্চিত হয়েছি, বাংলাদেশকে বর্জ্যের অভিশাপমুক্ত করা পাহাড় সমান সংকট নয়। শুধু উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতার প্রশ্ন। আমি দেশের বারোটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় যোগাযোগ করেছি। অনেকের অসাধারণ সাড়া পেয়েছি। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে ওই তৎপরতার ধারাবাহিকতা কিছুটা ব্যহত হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এক বৈপ্লবিক কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। মানুষ জানবে, বর্জ্যই আমাদের সবচেয়ে দামী সম্পদ।
ড.মঈনউদ্দিন সরকার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইউএসএ