চলতি অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমার পরিমাণ বাড়বে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবাসী-অনিবাসী নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ৭৫ লাখ ছাড়িয়েছে। অনিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা তার চেয়ে বেশি কারণ সরকার তাদের কাছ থেকে নানাভাবে উৎসে কর কেটে নেয়। আবার আমদানি পর্যায়ে উৎসে কর কাটার ফলে, বাংলাদেশের প্রায় সব নাগরিক পরোক্ষ কর দিয়ে থাকেন।
গত বছর দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চলে রিটার্ন দাখিল করেছিলেন প্রায় ২৯ লাখ করদাতা। সবাই যে রিটার্নের সঙ্গে আয়কর দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। অনেকের আয় করযোগ্য সীমার নিচে থাকায় কর প্রদান না করেও রিটার্ন জমা দিয়েছেন। কারণ, আইনের কিছু বিধানের ফলে তাদেরও রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। বেতনভোগী করদাতারদের বেলায় মূল বেতন ১৬,০০০/- টাকার বেশি হলেই নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সেসব কর্মকর্তা কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য নির্দেশনা দিতে হয়। সরকার এরূপ বিধান করার কারণ হলো, অনেকের বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও আয় থাকে অনেকের।
টিআইএন এর সংখ্যা এত অধিক অথচ আয়কর রিটার্ন জমাদানকারীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম এটি কেন— তা অনেকের কাছেই একটা বড় জিজ্ঞাসা। সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এটি হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন: অনেক নাগরিক ব্যবসা শুরু করতে টিআইএন গ্রহণ করেন কিন্তু তিনি হয়ত ব্যবসা করতে পারেননি নানা কারণে। কেউ হয়ত এমন কোনো কাজ করতে চাচ্ছেন যেখানে টিআইএন নম্বর থাকা জরুরি কিন্তু তার করযোগ্য আয় নেই...। এমন অনেক ক্ষেত্রে নাগরিকরা রিটার্ন দাখিল করেন না। অনেক সময় তারা অস্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে টিআইএন গ্রহণ করে পরবর্তীতে তাদের হদিস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায় আয়কর বিভাগের পক্ষে। অনেকে টিআইএন নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন বহু বছর ধরে। দেশে তাদের কোনো আয় নেই।
আবার এ কথাও সত্য যে গত কয়েক দশকে যেসব করদাতারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের টিআইএন এখনও রয়ে গেছে। সেসব ডাটাবেজ থেকে ডিলিট করে দিলে টিআইএন ধারীর সংখ্যা আরও কমে যাবে। মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদানের দরকার নেই। তবে মরহুমের সম্পদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আপস বণ্টন না হওয়া পর্যন্ত মরহুমের পক্ষে একজন বৈধ উত্তরাধিকারীকে (স্বামী বা স্ত্রী কিংবা সন্তান) আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড অর্থ আইনে এমন একটি ধারা সংযোজন করেছে যার ফলে নাগরিক/করদাতাদের দুই ডজনের ও বেশি ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সেবা/কাজ পেতে হলে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দাখিল করতে হবে। ইতোপূর্বে এসব ক্ষেত্রে টিআইএন সনদপত্র দাখিল করলেই হতো। কিন্ত এ বছর আয়কর রিটার্ন দাখিলের স্লিপ দাখিল করতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি।
* ৫ লাখ টাকার অধিক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে
* ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকার অধিক ঋণ নিতে হলে
* ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে
* ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা ইংলিশ ভার্সনে সন্তান ভর্তি করাতে হলে
* সিটি করপোরেশন বা সেনানিবাস এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে
* ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী শহরের বাড়ি নির্মাণের জন্য বাড়ির নকশা অনুমোদন বা নবায়ন করতে
* সিটি করপোরেশন বা জেলা শহরের পৌরসভা এলাকায় ১০ লাখ টাকার মূল্যের অধিক জমি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ইত্যাদি।
উপরোক্ত ক্ষেত্র ব্যতীত অনেকগুলো কাজের বেলায় করদাতা যে হাল নাগাদ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন তার দালিলিক প্রমাণ দাখিল করতে হবে। এই আইনের ফলে এ বছর আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা যেমন বিপুল আকারে বৃদ্ধি পাবে তেমনি আয়কর বিভাগের কাজের চাপও বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে আয়কর বিভাগের যে সংখ্যক জনবল রয়েছে তা মোটেও যৌক্তিক নয়। আরও কয়েকটি কর অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আয়কর অফিসের সংখ্যা বাড়ানো না হলে করদাতাদের হয়রানি বাড়বে এবং তারা দ্রুততম সময়ে আয়কর বিভাগের সার্ভিস পাবেন বলে মনে হয় না।
একই সঙ্গে কর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শুদ্ধাচার মেনে চলার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিক নির্দেশনা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, সাধারণ করদাতাদের আয়কর আইনজীবী নেই। তারা নিজেরা আয়কর অফিসে গিয়ে দ্রুত সেবা পেতে চান। সেক্ষেত্রে অহেতুক হয়রানির অভিযোগ ও করে থাকেন অনেকে। এসব বিষয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সচেতন হওয়া সময়ের দাবি।
লেখক: সাবেক কর কমিশনার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ট্যাক্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।
এসএন