স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি
আজকে আমরা যখন স্বাধীনতার কথা স্মরণ করছি, তখন আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের বন্ধুত্ব, তাদের সহযোগিতা আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছে। এরপর যখন দেশ স্বাধীন হলো, ১৬মার্চে যখন পাকিস্তানিদের আমরা পরাজিত করলাম, ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হলো, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তন করলেন, ১২ জানুয়ারি সরকার গঠন হলো, তখন প্রশ্ন আসলো, এখনতো আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখন আমরা কি করবো?
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনদেশেও কিন্তু আমাদের সেই চ্যালেঞ্জটা খানিকটা রয়ে গেল। পৃথিবীর অনেকদেশই আমাদের স্বীকৃতি দিতে দ্বিধান্বিত হলো, কারণ পাকিস্তানীরা বলছে যে, এটাতো ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ফসল। এটাতো পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র এবং পৃথিবীর অনেকদেশ সেটা বিশ্বাসও করেছে। ফলে আমাদের স্বাধীনতার প্রথম তিন চার বছর আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জটাই ছিল, আমরা কি করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিটুকু আদায় করতে পারবো এবং সেই সংগ্রামটা আমরা করে গেছি প্রথম তিনটি বছর। সেই সংগ্রামের একটি স্বীকৃতি আমরা পেয়ে গেছি যখন জাতিসংঘে আমরা সদস্যপদ লাভ করলাম। ১৯৭৪সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গিয়ে বাংলায় ভাষণ দিলেন। তার মাধ্যমে আমরা বলবো যে, স্বাধীন দেশ হিসেবে মোটামুটি স্বীকৃতির যে প্রক্রিয়াটি সেটি সম্পূর্ণতা অর্জন করলো।চীন এবং অন্যান্য দেশ ৭৫সালের মাঝামাঝি গিয়ে তারা স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমরা যে লড়ছি, আমাদের প্রত্যাশা যে একটা বড় উপাদান বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে, সেই বক্তব্যটি পৃথিবীর কাছে নিয়ে যাওয়াটি দরকার ছিল এবং সেক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ। তাতেও আমরা সফল হই। তৃতীয় জায়গাটিতে যদি আসি, বিদ্ধস্ত দেশ, রাস্তা নাই ঘাট নাই, ৮০% মানুষ দারিদ্র। এই জায়গায় একটি দেশকে চালু করা, তার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা, সেই কাজটিও কিন্তু আমাদের জন্য সহজ কাজ ছিল না। সে সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বন্ধুরা যারা ছিল, তাদের কাছে কিন্তু আমরা সহযোগিতা চেয়েছি এবং সেই সহযোগিতাটি আমরা স্বার্থকভাবেই পেয়েছি।
আমি সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তার প্রায় ৩৫শতাংশ কাজ, কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য কর্তৃক হয়। কাজেই বাংলাদেশের শৈশবকালের যাত্রা শুরু থেকেই কিন্তু আমরা বৈদেশিক সহযোগিতাটুকু পাই এবং এখনও পেয়ে আসছি। এর একটা অসাধারণ মুল্য কিন্তু আমাদের আছে। তখন আমরা যে প্রক্রিয়াটি শুরু করে সফলভাবে চালু করতে পেরেছিলাম, সেটা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চালু রাখতে ব্যাপকভাবে আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে এবং জেনে ভাল লাগবে যে, এখন বাংলাদেশ বিদেশি আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমরা ভাল একটি অবস্থানে আছি বলতে পারি।আগে আমরা খাদ্যে সহযোগিতা চাইতাম, এখন আমরা প্রকল্প সহযোগিতা চাই।
আমরা যে অর্থনৈতিকভাবে সবল হচ্ছি, আমরা যে দারিদ্র বিমোচনে সফল হচ্ছি, নারী উন্নয়নসহ শিক্ষা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা যে সফল হচ্ছি, তার ইঙ্গিতটা হচ্ছে, আমরা কিন্তু যে বিদেশি সহযোগিতা পাই এবং সেই সাহায্যটি কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আসে। খাদ্য সাহায্যের জন্য সেটা এখন আর প্রয়োজন হয়না। এটাকেও আমরা আমাদের অর্জনের একটি জায়গা হিসেবে দেখতে পারি।
এখনকার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবস দুটিরই যখন আমরা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, সেক্ষেত্রে আমাদের একটি অন্যতম বড় অর্জন হলো আমরা এখন স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি এবং এটি কিন্তু আমাদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ ২০২৬সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকা অর্জন করবো। এটা বড় ধরণের অর্জন আমরা বলতে পারি। এই অর্জনটি আমরা প্রত্যাশা করছি, আমরা আসলে মুখিয়ে আছি যে, এই অর্জনটি আমরা কিভাবে ঘটাবো। তবে বলতে পারি, আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে অর্জনের যে গল্প করছি, সেই অর্জনের গল্প কিন্তু সম্পূর্ণ একইসাথে খানিকটা অসম্পূর্ণ সেকথা আমাদের বলতেই হবে!
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত