প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও মনোযোগ দরকার
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশবছর পালন করছি আমরা। আমাদের এখন অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় অথবা উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় আমরা বেশ ভাল অবস্থানে আছি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বিষয়টি লক্ষনীয়। অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে এসেছে বাংলাদেশ।
আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসছে। সামস্টিকভাবে আমাদের যে উন্নয়ন সুচকগুলি সেগুলি ভাল। আরও একটি ভাল খবর যেটি, তাহলো জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী অনুন্নয়নশীল দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এটা একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি। আমরা এক জায়গায় আটকে না থেকে যেন সামনের দিকে এগুতে পারি । আমাদের আত্মপ্রসাদ নিলে চলবে না। কারণ সুষমবন্টন ভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু পিছিয়ে আছি। আয় এবং সম্পদের বণ্টন যদি আমরা দেখি, সেখানে বৈষম্য প্রচুর। দিনদিন বৈষম্য বাড়ছে। এটি ভাল লক্ষণ না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন মোটা দাগে সামস্টিক সুচকে হয়েছে কিন্তু উন্নয়নের সুফলটা নীচের স্তরে পৌঁছায়নি।
খেয়াল করলে দেখবেন, ঢাকা শহরে বা অন্যান্য শহরে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা আছেন, তাদের অপেক্ষাকৃত উন্নয়ন আমরা দেখছি না। তারা অনেকটাই পিছিয়ে আছে। শুধু অর্থনীতিতে নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রেই আরও উন্নতি দরকার। শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কোভিড অবস্থা যদিও ভালভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে সরকার। তবে একথাটিও সত্যি যে, দরিদ্র মানুষকে যদি তার চিকিৎসার জন্য একশ টাকা খরচ করতে হয়, সেটা নিজের পকেট থেকেই দিতে হয়। পৃথিবীর কোন দেশেই কিন্তু এই নিয়ম নেই। সেক্ষেত্রে সরকার বা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলি, তারপর সরকারি ক্লিনিক আছে সেগুলি বহন করে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা যদি বলি, এমনিতে রাস্তাঘাট হয়েছে তবে সেগুলির গুণগতদিকটিও খেয়াল রাখতে হবে বলে মনে করি।
সব সরকারই কিন্তু মাথাপিছু আয় প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেস্টা করেছে। রেমিটেন্স বাড়াবার চেস্টা করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নীতিমালা অথবা পলিসিগুলি ঠিক আছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রটি বেশ দুর্বল। নীতিমালাগুলি ঠিকভাবে হলেও তার বাস্তবায়নগুলি যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে আমি মনে করি। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সবচেয়ে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা হলো এখানে নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণটা কম। প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রিতায় এগুলো সহজে বাস্তবায়ন করা যায় না। আরেকটি বিষয় হলো, অর্থের অপচয় হয়, দুর্নীতি দিন দিন বাড়ছে। আমাদের রিসোর্স যেগুলি আছে, আমাদের যে সম্পদ, সেই সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এগুলি যদি আমরা ঠিক না করি, ভবিষ্যতে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও যেটি দেখলাম, কাজের ক্ষেত্রে বহুমুখিকরণ ঠিকমতো হয় না। তাছাড়া চামড়া, পাট, ঔষধশিল্প, সিরামিক ইত্যাদি এগুলির সম্ভাবনা আছে কিন্তু সুষ্ঠুভাবে বাড়ছে না। মানব সম্পদের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনভিজ্ঞ। দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে পারছি না। মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিক পাঠাচ্ছি। দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা এবং তাদেরকে বাইরে পাঠানো, সেটি আরও যথাযথভাবে হওয়া উচিত। আরও একটি দুর্বল দিক আমাদের, শিল্পে উন্নয়ন বিশেষ করে বড় শিল্পগুলি ভাল করলেও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলি অনেকটা পিছিয়ে আছে। এখানে অর্থায়ন একটি সমস্যা। ব্যাংকগুলি অর্থায়ন করতে চায় না। কৃষকরাও কিন্তু যথাযথভাবে প্রণোদনা পায় না। যদিও কৃষকরা আমাদের খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছে।
আমাদের আর্থিকখাত, প্রশাসনিক খাতে যথেষ্ট জবাবদিহিতার দরকার আছে। মনিটরিং অর্থাৎ নজরদারির দরকার আছে। পুজিবাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্বলতা আছে। ব্যাংকগুলি বড় বড় ব্যাবসায়িদের দ্বারা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। ছোট বা মাঝারি ব্যাবসায়িদের কাছে পুজি যাচ্ছেনা । আমাদের ব্যাংকখাত চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে। এখানে সুশাসনের অভাব। নানারকম দূর্নীতি হচ্ছে। এগুলি যদি আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি, তাহলে সেটি আমাদের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে কঠিন হবে। পরিশেষে বলতে পারি, জনগণের অংশগ্রহণ দরকার। জনগণ যদি নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের মতামত, সেটি স্থানীয় পর্যায়ে হোক আর জাতীয় পর্যায়ে হোক তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বছরে এইসব প্রতিবন্ধকতাগুলি চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা আবশ্যক বলে আমি মনে করি।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর