শ্রদ্ধাঞ্জলি: গণপরিষদ সদস্য তোয়াবুর রহিমের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী
আমৃত্যু সমাজসেবায় নিয়োজিত এক মানুষ
চারপাশে ধানিজমি। এদিক-ওদিকে মেঠোপথ। তার মাঝে বিরাট পুকুরসহ সাদামাটা একটি বাড়ি। বর্তমান বাস্তবতায় বাড়ি দেখে কেউ হয়তো ভাবতে পারবে না- এটি একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংসদ সদস্যের বাড়ি। কিন্তু এটাই সত্যি। ফসলের সময় বাড়িটির আশপাশে একহাতে ছড়ি, অন্য হাতে ছাতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। নিজের তত্ত্বাবধানে লাগানো ফসল ঘুরে ঘুরে দেখতেন। এমন একেবারে সাদামাটা জীবন যাপনের অধিকারী মানুষটি হলেন আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিম।
আজ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১। প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, মহান সংবিধানে স্বাক্ষরদানকারী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্য পাওয়া প্রবীণ অাওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি 'রাজনগর-কমলগঞ্জ' আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। যা পরবর্তীতে গণপরিষদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি ওই আসন (রাজনগর-কমলগঞ্জ আসন, সিলেট ১৪) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিম ইংল্যান্ডের একটি হাসপাতালে গত বছরের এই দিনে (২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর) শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জঠিলতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ তিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৯২ বছর।
রাজনীতির শুরুতে আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিম রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৬৫ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সাদামাটা জীবন যাপনের অধিকারী কিন্তু দৃঢ়চেতা এই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোয়াবুর রহিম মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের বালিসহস্র গ্রামে ১৯২৯ সালের ০৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মো. ছালামত মিয়া এবং মায়ের নাম শামসুন্নাহার খাতুন। তিনি দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেখানে তার আরও এক ভাই এবং তিন বোন আছেন। আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিমের স্ত্রীর নাম রহিমুন্নেছা। তিনি ছয় ছেলে এবং এক মেয়ের জনক।
শিক্ষানুরাগী তোয়াবুর রহিম ১৯৭১ সালে তার বাবার নামে হাজী ছালামত স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া উত্তর বালিসহস্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ স্থানীয় বাজার যা 'এমপির বাজার' নামে সুপরিচিত- তিনি তারও প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন এবং স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ড চলে যান। দীর্ঘ সময় পর ৯০ দশকের প্রথমার্ধে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে এলাকার শিক্ষাবিস্তারে আমৃত্যু অবদান রেখে গেছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি 'হাজী ছালামত স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়' এবং 'উত্তর বালিসহস্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়'র সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার স্ত্রী, সন্তানরা উন্নত চিকিৎসার জন্যে পুনরায় তাকে ইংল্যান্ড নিয়ে যান। কিন্তু কোভিড-১৯ সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ২০২০ সালের এই দিনে (৩১ ডিসেম্বর) তিনি ইংল্যান্ডের রাজধানী শহর লন্ডনের চেরিংক্রস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
চলতি সংসদের (একাদশ) দ্বাদশ অধিবেশনের শোক প্রস্তাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সজ্জন এই রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিমের নাম।
দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে বসবাসের সুবাদে সেখানকার বাঙালি কমিউনিটিতেও তিনি ছিলেন অতি পরিচিত মুখ। তার মৃত্যুতে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীমের শোক বার্তায় সেটি গুরুত্ব সহকারে ফুটে উঠেছে। তিনি তোয়াবুর রহিমের বিভিন্ন কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, 'তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশি-ব্রিটিশ ভাই ও বোনেরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশি-ব্রিটিশ কমিউনিটির কল্যাণে আজীবন নিবেদিত-প্রাণ একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে হারালো।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান এবং যুক্তরাজ্যে ও বাংলাদেশে অনেক জনহিতৈষী কাজের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলার প্রবীণতম রাজনীতিবিদ মরহুম তোয়াবুর রহিম বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি ব্রিটিশদের মধ্যে চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।'
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী প্রগতিশীল, স্থিতধী, সমাজসেবক এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব তোয়াবুর রহিমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
এনএইচবি /এএন