মহীয়সী বঙ্গমাতা: বিশ্বনারীর অনুপ্রেরণা
আজ ৮ আগস্ট মহীয়সী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর ৯২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে দেশব্যাপী। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জন্মবার্ষিকী উদযাপন সেই সঙ্গে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পদক প্রদান অনুষ্ঠান ২০২২ আরেক আনন্দের বার্তার পালক নাড়ছে।
আমরা নারী সমাজ গর্বের সঙ্গে এই মহীয়সী নারীকে স্যালুট জানাই। তিনি প্রতিটি মুহূর্তে দেশের কথা দশের কথা ভেবেছেন, দেশসেবায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছেন। ৮ আগস্ট ২০২২ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর ৯২তম জন্মবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য নিম্নরূপ-
মহীয়সী বঙ্গমাতার চেতনা
অদম্য বাংলাদেশের প্রেরণা
‘The spirit of glorious Bangamata
The inspiration of indomitable Bangladesh’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এক অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী নারীর নাম। গৃহ থেকে রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক আলোকবর্তিকা রুপে হাজির হয়েছেন তিনি। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল রেণু। ১৯৩৪ সনে দাদা আব্দুল হামিদের আদেশে শেখ মুজিবের বাবা ১৪ বছর বয়সে তার সঙ্গে তার বাবার সম্পর্কের আত্মীয় বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে দেন। বিয়ের ৯ বছর পর ১৯৪২ সালে তারা দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। এক বালিকা বধূ শেখ মুজিবের জীবনের বড় কর্মপ্রেরণা ও পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। মুজিবের পরিবারটি বাঙালি পারিবারিক জীবনের ঐতিহ্য বহন করে। পরিবারটি ছিল যৌথ ও বর্ধিত কাঠামোর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও ঐক্যবদ্ধ। রাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই মহীয়সী নারীর অবদানও কম নয়। বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে ছোট জীবনতরী সঠিকভাবে পরিচালনায় তার ছিল অভাবনীয় ক্ষমতা।
একজন নেতা হয়ে উঠা এবং জেল জুলুমের মধ্যে আদর্শকে সমুন্নত রাখা ও সর্বোপরি মুজিবের জীবনে সুখ সমৃদ্ধি ও পারিবারিক ঐক্য বজায় রেখে দায়িত্ব পালনে বেগম মুজিব ছিলেন অতুলনীয়। তাইতো তিনি মহীয়সী, তিনি বঙ্গমাতা। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রচেষ্টায় বীরাঙ্গনা বা বীরকন্যা নারীদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদা প্রদান এবং দশজন বীরাঙ্গনা বা বীরকন্যা নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২১, শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন-
রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। পতিভক্তি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবন জুড়ে রয়েছে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৫ স্ত্রীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ ভালোবাসার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘রেণুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোটভাই ওদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলছিলাম। হাসিনা, কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না। বাড়ির কেউ খবর পায় নাই, পেলে নিশ্চয়ই আসত।’
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নেপথ্য কারিগর ও অসাধারণ মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন মহীয়সী নারী। দেশ ও জাতির জন্য অপরিসীম ত্যাগ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতা তাকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭১র মহান স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেপথ্য শক্তি, সাহস ও বিচক্ষণ পরামর্শক ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গঠিত মুজিবনগর সরকারের পক্ষে জনমত গঠন এবং বিশ্বব্যাপী স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গমাতা রাজনীতির আদর্শ দার্শনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি সঠিক সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছপা হননি। তার দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা ও সাহসিকতার পরিচয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখতে পাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী ও লাঞ্চিত মা বোনদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন। ভারত, ব্রিটেন ও জার্মানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক্তার এনে গোপনীয়তা রক্ষা করে তাদের চিকিৎসাসহ সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করেন।
তোফায়েল আহমেদ বঙ্গমাতাকে নিয়ে লিখেছেন তার এক নিবন্ধ- শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতার কাছে শুনেছি, ৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার আগে ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু অস্থিরভাবে পায়চারি করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, তুমি এত চিন্তা কর কেন? সারাজীবন একটা লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছ, কারাগারে গিয়েছ, জেল খেটেছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তোমার বিশ্বাসী অন্তর থেকে যা ভালো মনে করো এই মিটিংয়ে তুমি তাই বলবা, দেখবা মানুষ সেটাই গ্রহণ করবে, তুমি এখন ঘুমাও।
বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী ছিলেন। কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই দুটো লেখার পেছনেও রয়েছে বঙ্গমাতার অবদান। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুখ দুঃখের সঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা। তারা ছিলেন আদর্শ দম্পতি, আদর্শ যুগল।
মহীয়সী বঙ্গমাতা সব বাঙালি নারীর অনুপ্রেরণার উৎস। তার দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দক্ষতা, দূরদর্শিতা, মহানুভবতা, মানবকল্যাণ বিশ্বের সব নারীর কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে। বঙ্গমাতার এ সব অবদানকে চিরস্মরণীয় করতে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের‘ জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ শীর্ষক ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রবর্তন করেছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের একটি মাইলফলক হবে। তিনি নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য কুটিরশিল্পসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মেধাবী দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি বঙ্গমাতা ছিলেন স্বাধীন দেশে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের প্রকৃত নীরব পথ প্রদর্শক। আমৃত্যু নেপথ্যে থেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় সহধর্মিনী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯২তম শুভ জন্মদিনে তার অমর স্মৃতির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক
আরএ/