জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে নতুন আঘাত
জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে নতুন সংকটের জন্ম দেবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি পরিমাণে তেলের দাম বৃদ্ধি আগে কখনো ঘটেনি। সরকারের মন্ত্রী বলছেন বাধ্য হয়ে তারা এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়া এবং দরপতনের সঙ্গে মন্ত্রীর কথার তো কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অতীতে যখন দাম কমে গিয়েছিল তখন যে ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছিল তার সুফল যেমন জনগণ পায়নি আবার এখন দাম যে কমতির দিকে তারও স্বস্তি পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
গত ১ আগস্ট বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১ দশমিক ১৯ ডলার বা ১ দশমিক ১ শতাংশ কমে হয়েছে ১০২ দশমিক ৭৮ ডলার। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দর প্রতি ব্যারেল এখন ৯৭ দশমিক ১৯ ডলার। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ১ দশমিক ৪৩ ডলার বা দেড় শতাংশ কমেছে। পরিশোধিত ডিজেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যারেলে ১৭০ ডলার থেকে নেমে ১৩০ ডলারে নেমে এসেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ১০০ ডলারের মধ্যে এসেছে। এই দর আরও কমবে এবং ৭০ থেকে ৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
বিশ্ববাজারে যখন দাম পড়তির দিকে তখন দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত সাধারণ মানুষের জীবনে পেট্রল পণ্যের এই উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি মরণ আঘাতের মতো মনে হবে। নাগরিক জীবনের প্রভাব পড়বে বিদ্যুতের দাম, পানির দাম, পরিবহন ব্যয়, খাদ্য পণ্যের দামসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে। কারণ, সবমিলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিক্রি করা মোট জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাতে ৭ ও বিদ্যুৎ খাতে ১০ শতাংশ তেল ব্যবহৃত হয়।
কয়েকদিন ধরে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও বলা হচ্ছিল তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অনেকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে আর অকস্মাৎ ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হলো। এটা কি জনগণকে বোকা বানানোর নতুন কোন কৌশল?
একসঙ্গে এত বেশি দাম এর আগে কখনো বাড়ানো হয়নি। এখন এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ১১৪ টাকা লাগবে। এক লিটার অকটেনের জন্য দিতে হবে ১৩৫ টাকা। আর প্রতি লিটার পেট্রলের দাম হবে ১৩০ টাকা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানের উৎপাদন হয় আমন মৌসুমে। ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। জুনে বন্যা হলেও এবার বৃষ্টিবিহীন শ্রাবণ মাস। আমন ধান চাষ করতে এবার পানি পাচ্ছে না কৃষক। প্রতি বিঘা জমিতে সেচ দিতে ২০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। তাহলে সেচের জন্য খরচ লাগবে ২২৮০ টাকা। আর এবারের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত লাগবে ৬৮০ টাকা। প্রতি বিঘায় ইউরিয়া সার লাগে ৩৫ কেজি। কদিন আগেই সরকার সারের জন্য অতিরিক্ত খরচ বাড়িয়ে দিল প্রতি বিঘায় ২১০ টাকা।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই এ কথা আলোচিত হচ্ছে যে কয়েকজন বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীর জন্য বছরে গড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। তাহলে জনমনে প্রশ্ন জাগে, ১৬ কোটি লোকের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে পারে না কিন্তু চাইলেই তো ১৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত। আর এ কথা বলা তো হচ্ছেই যে অকটেন-পেট্রল তো নিজস্ব গ্যাস কূপের'বাই-প্রডাক্ট', তাহলে তা আমদানি আর দাম বৃদ্ধির প্রশ্ন আসে কীভাবে? প্রশ্নের উত্তর না পেলেও বাস্তবে দাম বৃদ্ধির আঘাত জনজীবনে এল।
সরকার এর আগে গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল লিটার প্রতি ৮০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ। এবার তাহলে কত বাড়বে? ইতোমধ্যে বাস মালিকরা দর কষাকষি শুরু করেছেন। বাসভাড়া, পণ্য পরিবহনে ট্রাক ভাড়া সবই বাড়বে। এবং তা গতবারের চেয়ে বেশি হারেই বাড়ানো হবে।
এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের পর গত ৫ জুন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয় প্রায় ২৩ শতাংশ। বাসাবাড়িতে দুই চুলার গ্যাস বিল ৯৭৫ টাকাথেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়।
ইতোমধ্যে ঢাকা ওয়াসা গত ৮ জুলাই পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। দাম আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে ওয়াসা। সারের দাম, তেলের দাম, পানির দাম বাড়ল, এর পর আসছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা। আয় বৃদ্ধির পথ তো নেই। কেমন করে বেঁচে থাকবে সাধারণ মানুষ। খাওয়ার খরচ আর জীবনের অন্যান্য ব্যয় কমানোর পথ খুঁজতে খুঁজতে তাদের জীবন কি দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে না?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)