গণ মানুষের বিজয় অর্জনের সংগ্রাম চলছে
বিজয় দিবস উদযাপিত হলো মহাসাড়ম্বরে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু সময়ের হিসেবে পার হয়ে গেছে ৫০ বছর। বাংলাদেশ পালন করছে সুবর্ণ জয়ন্তী। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয় বরং অনেকেই বলছেন বিস্ময়কর। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির চিত্র দেখি তাহলে দেখবো মাথাপিছু আয় ১১০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ২৫৫৪ ডলার, জিডিপি ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে হয়েছে ৩৩৮ বিলিয়ন ডলার।খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। অন্তত ১৩ টি ক্ষেত্রে উৎপাদনে বাংলাদেশবিশ্বে শীর্ষ স্থানে আছে বলে তথ্যে জানা যায়। ধান উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ মাছে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, প্রবাসী আয়ে অষ্টম, সব্জি উৎপাদনে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, কাঁঠালেদ্বিতীয়, আমে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম, পাটে দ্বিতীয়, মিঠা পানির মাছে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনেচতুর্থ আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, আউট সোরসিং এ দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ।এ ছাড়াওযমুনা সেতু, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল এবং সর্বশেষ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অগ্রগতিকে দৃশ্যমান করেছে।
প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে এই ভূখণ্ডের মানুষের বুকে পরাধীনতার গ্লানি আর চোখে স্বাধীনতার স্বপ্নে সংগ্রাম করেছে । ব্রিটিশরা কৌশলে দ্বিজাতি তত্ত্বের নামে ধর্ম ভিত্তিক জাতিয়তার যে বীজ বপন করে তার ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে উঠে পাকিস্তান। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ হয় নি। যদি তা হত তাহলে এশিয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল মিলে একটি মুসলিম দেশ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হয় নি। চীন, জাপান, কোরিয়া মিলে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ হয়নি তেমনি ভারত নেপাল মিলে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেশ হয় নি। কারণ দেশ হতে গেলে ভূখণ্ডগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক বন্ধন, ভাষা, অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতি দরকার হয়। যে কারনে এক ধর্মের মানুষ হলেও তাদেরকে নিয়ে এক দেশ হয় না। তাই হাজার মাইলের ভৌগলিক দূরত্ব, ভাষা সংস্কৃতির পার্থক্য নিয়ে শুধু মাত্র ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের যে দেশ গড়ে তোলা হয়েছিল তা কোন বিচারেই এক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল না।
পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্র ঐক্য প্রতিষ্ঠার নামে যে সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল তাতে মোহ ভঙ্গ হতে বেশি দেরি লাগেনি। ভাষার উপর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ৫২, শিক্ষার অধিকার সংকুচিত করার প্রতিবাদে ৬২, সংস্কৃতির উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ৬৫, ৬ দফার লড়াইয়ে ৬৬, সামরিক শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান ৬৯, মানুষের বিপুল অংশগ্রহণে নির্বাচনে ধ্বস নামানো বিজয় ৭০ এবং ৭১ এর সশস্ত্র লড়াই ধারাবাহিকভাবে আমাদের আকাংখাকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তার বিপরীতে ধর্ম নিরপেক্ষতা, পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র তার বিপরীতে গনতন্ত্র, ব্রিটিশ শোষণ ও পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে শোষণ মুক্তির আকাংখা থেকে সমাজতন্ত্র আর দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক ও পাকিস্তানি প্রায় উপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ, এই আকাংখাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের চেতনায়। তাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে সব পথ যেন মিশে গিয়েছিল মুক্তির আকাংখায়, স্বাধীনতার মোহনায়।
কিন্তু ৫০ বছর পরে আকাংখা আর প্রাপ্তির হিসেব মেলাতে গেলে দেখা যাবে অনতিক্রম্য এক বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে । স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল যারা আর সুফল ভোগ করছে যারা তাঁরা একই দেশের মানুষ হয়েও যেন এক জাতের মানুষ নয়। দুইজন বাঙালি কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে আজ সোয়া লাখের বেশি কোটিপতি। এদের মধ্যে আবার ২৫০ জন যে কোন দেশের বিবেচনায় অতি ধনীর পর্যায়ে পরে। শ্রমিকের এবং প্রবাসী শ্রমিকের শ্রমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু এর পাশাপাশি যে চিত্র আমাদেরকে পীড়িত করে তা হল, প্রায় দেশের ৭ কোটি শ্রমজীবী মানুষ যাদের মজুরী বিশ্বে সবচেয়ে কম, এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী তাদের শ্রম বিক্রি করছেন বিদেশের বাজারে, দেশে বেকারত্ব এততীব্র, যে কোন একটাকাজ পাবার জন্য যুবকরা মরিয়া হয়ে জীবনের ও আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে বিপদ সংকুল ও অনিশ্চিত পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কৃষক ধান, সব্জি, মাছ, ফল চাষ করে ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। অন্যদিকে বাজার সিন্ডিকেটের কারনে খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছেই। শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাতের নিত্য নতুন খবর আসছে, প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছে ধনীরা, সে টাকা জমছে বিদেশের ব্যাংকে। মানুষ দেখছে দেশের জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বৈষম্য আর দুর্নীতি সবই বাড়ছে। তখন প্রশ্ন আসে, ৫০ বছর পর এই দৃশ্য আমরা কি দেখতে চেয়েছিলাম?
ধর্মকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা ধর্ম নিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তুধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দুটোই বেড়েছে, ক্ষমতার স্বার্থে এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকের সাম্প্রদায়িকিকরন এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মাদনা বাড়ছে। সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য এখন প্রধান ধারা, ফলেধনী দরিদ্রের ব্যবধান আকাশচুম্বী। সামাজিক ন্যায়বিচার এখন মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মানবিক মর্যাদা যে ভূলুণ্ঠিত তা নারীর লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার উপর আক্রমণের চিত্র দেখলে বুঝা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং চর্চা এখন সবচেয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে। নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ না করে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধ ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। টাকা, পেশি শক্তি, প্রশাসন ও সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে নির্বাচনকে কলুষিত করার কাজ তো ধারাবাহিকভাবেই চলছিল কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, সংসদের উপ নির্বাচন এবং চলমান ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সবচেয়ে খারাপ নজীর সৃষ্টি করেছে।
১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ আর আমাদের বিজয়ের প্রাক্বালে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার তারা মুক্তি পাবে শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে, আর মাথা নিচু করে থাকা নয়, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার মত পরিবেশ পাবে। তা এখনও অর্জিত হয়নি। এর কারণটা খুঁজে বের না করলে হতাশা গ্রাস করবে এবং ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। স্বাধীনতার পর যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে তার ফলেই শোষণ ও বৈষম্য এত প্রকট রূপ নিয়েছে। একারনেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয় নি কিন্তু শোষকদের প্রাপ্তি ঘটেছে ব্যাপক। শোষণ ও লুণ্ঠনকে অব্যাহত রাখতেই নিপীড়ন যেমন বাড়ছে, শোষণকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাও তেমনি প্রশ্রয় পাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের এই প্রবল জোয়ারেও গনতন্ত্র ও নৈতিকতার ভাটার টান মানুষ প্রত্যক্ষ করছে।
৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও জনগণ বিজয়ী হতে পেরেছে কিনা সে প্রশ্ন এখনো থেকেই যাচ্ছে। ৭২ সালে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিলো তাতে কিছু দুর্বলতা থাকলেও একথা তো স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে রাষ্ট্র ধর্ম, সমাজতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদী মুক্ত বাজার অর্থনীতি, জাতীয়তাবাদের বদলে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া তো জনগণ ৫০ বছরে প্রত্যক্ষ করছেন। আর গণতন্ত্রের বেহাল দশা দেখছেন প্রতিদিন।
গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ নির্বাচন। ৫০ বছরেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার আইন ও প্রক্রিয়া চালু করা গেল না। বরং তা এখন জটিল রোগে আক্রান্ত বলে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন। তিনি আবার বলেছেন স্বাধীনতার ৫ দশক পরে আমরা কি অন্ধকার ঘরে কালো বিড়ালের মত গনতন্ত্রকে খুঁজছি? আর বাক স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘তরুণ বয়সে আমি একটি লেখা এক ঘণ্টায় লিখে ফেলতে পারতাম। এখন এক সপ্তাহ লাগে। আমাকে বারবার ভাবতে হয় কী লিখছি।‘ এর অর্থ গনতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা দুটোই আজ বিপন্ন ! ৫০ বছরে যে গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হওয়ার কথা, বৈষম্য নির্মূল হওয়ার কথা তার বিপরীতে দেশ হাঁটছে। ভঙ্গুর গণতন্ত্র আর প্রকট বৈষম্যের দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?
আকাশচুম্বী আশা নিয়ে, সাগর পরিমাণ রক্ত দিয়ে, প্রতিজ্ঞা আর সাহসে ভর করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে রাইফেল, মুখে বিজয়ের উল্লাস নিয়ে আর সবুজের বুকে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়িয়ে যখন তারা দেশে মার্চ করছিলো তখন সন্তানহারা মা যেমন তার বেদনা ভুলে গিয়েছিলো তেমনি সম্ভ্রমহারা বোনটি মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিলো। ভেবেছিল সবাই, ব্রিটিশ, পাকিস্তানতাড়ালাম, এবার দেশটা আমাদের হবে। কিন্তু হয় নি । দালান কোঠার উন্নয়নের নিচে চাপা পড়া গণতন্ত্র আর বৈষম্যের গহবরে বিলীয়মান সাম্য উদ্ধারের সংগ্রাম তাই করতে হচ্ছে এখনও।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)