উপসর্গহীন রোগী কোভিড ছড়াচ্ছেন
অনেকের করোনার কোনো রকম উপসর্গ ছিল না। ওরা হাসপাতালে এসেছিলেন অন্য নানা অসুখ নিয়ে। কিন্তু ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সব জেলা মিলিয়ে ২৮টি সরকারি হাসপাতালে ৪০০ জন করে আসা এমন মোট ১১ হাজার ২০০ জন তথাকথিত অ-করোনা রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের একটা বড় অংশেরই কোভিড হয়েছে।
এই ফলাফল পাওয়া গেছে পঞ্চম দফার সেন্টিনেল সার্ভেতে। বাংলার সব জেলায় ৬-৮ জুলাই হওয়া ওই সার্ভেতে দেখা যায়, গোটা রাজ্যে ছেয়ে রয়েছে এমন উপসর্গহীন কোভিড পজিটিভে। এই সার্ভেতে দেখা গেছে, অন্তত নয়টি জেলায় পজিটিভিটি রেট ৫-১০ শতাংশ এবং ১১টি জেলায় পজিটিভিটি রেট ১০ শতাংশ বা তার বেশি, যার মধ্যে দুটি জেলার পজিটিভিটি রেট আবার ২০ শতাংশ বা তার বেশি। অথচ এক পক্ষকাল আগেও, চতুর্থ সেন্টিনেল সার্ভেতে পাঁচ শতাংশ বা তার বেশি পজিটিভিটি রেট ছিল না একটি জেলাতেও।
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, এর থেকে ভালো-মন্দ দু'টি বিষয়ই উঠে আসে। মন্দ দিকটা হল— সরকারিভাবে এখন দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যাটা যা, তা আসল সংক্রমিতের সংখ্যার নিরিখে অনেকটাই কম। সারা বাংলায় অনেক বেশি মানুষ রয়েছেন, যারা কোভিড পজিটিভ হয়েও উপসর্গহীন। ভালো দিকটা হল— তেজ কমিয়ে আর পাঁচটা সংক্রমণের মতো করোনাও যে থেকে যাবে জনগোষ্ঠীতে এবং তাতে অসুস্থতা তেমন ভয়াবহ হবে না, এই সেন্টিনেল সার্ভের পরিসংখ্যান তারও ইঙ্গিতবাহী।
উপসর্গ নেই, এমন করোনা রোগী কেমন অনুপাতে লুকিয়ে রয়েছে জনগোষ্ঠীতে, তা জানতেই ১৫-২০ দিন অন্তর ২৩টি জেলা ও পাঁচটি স্বাস্থ্যজেলা মিলিয়ে জেলা সদর বা মেডিক্যাল কলেজ স্তরের মোট ২৮টি হাসপাতালে সেন্টিনেল সার্ভে করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। ওই সব হাসপাতালে আসা এমন রোগীদের করোনা পরীক্ষা করা হয়, যাদের করোনার কোনো উপসর্গই নেই। অথচ পরীক্ষা করলে অনেকেরই ধরা পড়ছে করোনা।
চিকিৎসকরা বলছেন, এর দুটো দিকই সত্যি। একদিকে যেমন সংক্রমণটা উপসর্গ ছাড়াই বিপুলভাবে রয়ে যাচ্ছে জনগোষ্ঠীতে, তেমনই আবার সংক্রমিত হয়েও অনেকেই করোনার উপসর্গে কাবুও হয়ে পড়ছেন না। মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ অরিন্দম চক্রবর্তী বলেন, ‘যাদের উপসর্গ থাকছে, তাদের সিংহভাগেরই অসুস্থতা এতটাই মৃদু যে অধিকাংশ মানুষ টেস্টই করাচ্ছেন না। ফলে সংক্রমিতের আসল সংখ্যাটা ধরা পড়ছে না কোভিড বুলেটিনে। আর যারা উপসর্গহীন, তারা শুধু শুধু টেস্ট করাবেনই বা কেন? এরা সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন বটে, তবে ঝাঁঝ বেশ কম।’ একমত ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তার কথায়, ‘সেন্টিনেল সার্ভে জানান দিচ্ছে, জনগোষ্ঠীতে ভাইরাসের উপস্থিতি যথেষ্ট বাড়লেও তা আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলেনি। আক্রমণের ধার যে কমেছে, তা তো বলাই যায়।’ তার মতে, ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি মানুষের টিকা নিয়ে নেওয়া, বুস্টার ডোজ এবং গত আড়াই বছরে এক বা একাধিকবার কোভিডে আক্রান্ত হয়। সব মিলিয়ে জনগোষ্ঠীতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। রাজ্যে দৈনিক আক্রান্ত টানা তিন দিন তিন হাজারের দোরগোড়ায় থাকার পর সোমবার দু'হাজারের নিচে নেমে এল। কিন্ত রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে রাজ্যে দেনিক সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছিল, একই ভাবে এ বারও ওঠা-নামার মধ্যে দিয়েই সংক্রমণ বাড়তে পারে রাজ্যে। তাই দৈনিক আক্রান্ত কমলে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, দীর্ঘ ছ'মাস পর দৈনিক সংক্রমণের হার আবার ২০ শতাংশের উপর উঠল। এটি উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। সে দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে অক্ষরে অক্ষরে কোভিডবিধি পালনের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা । গত ২৪ ঘণ্টায় তিন জন কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরের করা কোভিডের ‘সেন্টিনাল সার্ভে’ রিপোর্ট। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড রোগীদের পরীক্ষা করে এই সমীক্ষা চালানো হয়। সংক্রমণ নিঃশব্দে বাড়ছে কি না, তা বুঝতেই এই সমীক্ষা। তাতে দেখা গেছে, রাজ্যের ১১টি জেলায় সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের উপর। তার মধ্যে রয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনা, নন্দীগ্রাম স্বাস্থভেলা, পশ্চিম বর্ধমান, দার্জিলিং ও কলকাতা । সোমবার রাঙা দফতর প্রকাশিত কোভিউ বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৮ ঘণ্টায় রাজ্যে নতুন করে করোনায় আত্রান্ত হয়েছেন ১৯১৫ জন। এখন পর্যন্ত কোভিড নেট আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৫৩ হাজার ৬২৬ জন। নতুন সংক্রমিতদের মধ্যে অধিকাংশই কলকাতা উত্তর ২৪ পরগনার অধিবাসী।। কলকাতায় আক্রান্ত ৪৯৮ জন। আর উত্তর ২৪ পরগনায় ৫৬৮ জন। কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ওই তিন জেলার কোভিড পরিস্থিতিও প্রশাসনের নজরে রয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে গুরু করেছে পশ্চিম বর্ধমান, নদিয়া ও বীরভূমেও।
রাজ্যে এখনও পর্যন্ত কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ২৪৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে কোভিড পরীক্ষা হয়েছে ৮ হাজার ৯৯৬ জনের। দৈনিক সংক্রমণের হার বেড়ে হল ২১.২৯ শতাংশ। রাজ্যে বর্তমানে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে ২৪ হাজার ২০৯ জন। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গোটা ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বাড়ছে করোনা। গত প্রায় দু'মাস ধরেই করোনা গ্রাফ আবার উপরের দিকে। রবিবার পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতর প্রকাশিত কোভিড বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় এপার বাংলায় নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৬২ জন। ছুঁয়ে না ফেললেও শুক্রবার ও শনিবারের পর রবিবারও তিন হাজারের দোরগোড়ায় কলকাতা-সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক আক্রান্ত ।
চিকিৎসক মহলের আশঙ্কা ছিল, চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছিল, একইভাবে এ বারও ওঠা-নামার মধ্যে দিয়েই সংক্রমণ বাড়তে পারে রাজ্যে। দৈনিক সংক্রমণের সাম্প্রতিক রেখাচিত্রও সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পর দৈনিক আক্রান্ত কমলেও উচ্ছৃসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ দৈনিক সংক্রমণের হার আবার বেড়ে ১৭ শতাংশ ছাড়াল। সে দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে অক্ষরে অক্ষরে বিধি পালনের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা । গত ২৪ ঘণ্টায় চার জন কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রবিবার পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর প্রকাশিত কোভিড বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৬২ জন। এখনও পর্যন্ত কোভিডে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লক্ষ ৫১ হাজার ৭১১ জন। রাজ্যে নতুন করে যত সংক্রমিত হয়েছেন, তার মধ্যে অধিকাংশই কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার অধিবাসী। কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলিতেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ওই তিন জেলার কোভিড পরিস্থিতিও প্রশাসনের নজরে রয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে পশ্চিম বর্ধমান, নদিয়া ও বীরভূমেও। এপার বাংলায় এখনও পর্যন্ত কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ২৪৩ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে কোভিড পরীক্ষা হয়েছে ১৭ হাজার ৬১ জনের। দৈনিক সংক্রমণের হার কমে হল ১৭-৩৬ শতাংশ।
বুধবারই রা্জ্যে দৈনিক আক্রান্ত দু'হাজারের গণ্ডি টপকে গেছে। বৃহস্পতিবার তা আরও বেড়ে পৌঁছে গেল তিন হাজারের দোরগোড়ায়। কলকাতাতে দৈনিক আক্রান্ত আটশোর উপরেই থাকল। কিন্তু মহানগরীকে ছাপিয়ে গেল উত্তর ২৪ পরগনা । সাড়ে পাঁচশো থেকে দৈনিক আক্রান্ত সোজা সাড়ে আটশোর কাছে পৌঁছে গেল ওই জেলায়। চিকিৎসক মহলের আশঙ্কা ছিল, চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছিল, এ্কইভাবে এ বারও ওঠা-নামার মধ্যে দিয়েই সংক্রমণ বাড়তে পারে রাজ্যে। গত বুধবার দৈনিক সংক্রমণের তিন হাজারের কাছে পৌঁছে যাওয়া সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরপর দৈনিক আক্রান্ত কমলেও উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ,দৈনিক সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখীই। বাড়তে বাড়তে তা ১৯ শতাংশের কাছে পৌঁছে গেছে। সে দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে অক্ষরে অক্ষরে কোভিডবিধি পালনের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এরই পাশাপাশি, গত ২৪ ঘণ্টায় দু'জন কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য দফতর প্রকাশিত কোভিড বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৮৯ জন। এখনও পর্যন্ত কোভিডে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৩১ জন| রাজ্যে নতুন করে যত সংক্রমিত হয়েছেন, তার মধ্যে অধিকাংশই কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনার অধিবাসী। মহানগরীতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮১৯ জন আর উত্তর ২৪ পরগনার আক্রান্ত ৮৩৪ জন। কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলিতেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ওইতিন জেলার কোভিড পরিস্থিতিও প্রশাসনের নজরে রয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে পশ্চিম বর্ধমান, নদিয়া ও বীরভূমেও। রাজ্যে এখন পর্যন্ত কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ২৩৩ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে কোভিড পরীক্ষা হয়েছে ১৫ হাজার ৪১৬ জনের। দৈনিক সংক্রমণের হার কমে হল ১৮.৭৪ শতাংশ । রাজ্যে বর্তমানে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৬ হাজার ৫৪৬।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক
আরএ/