নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা রুখবে কে?
আমরা প্রায়শই দেখি ঈদ, পূজা, পার্বণ ও যেকোনো উৎসবকে সামনে রেখে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনগণের পকেট কাটেন। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইতোমধ্যে কারসাজি করে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে বাজারে সব ধরনের চাল, পেঁয়াজ, মসলাজাতীয় পণ্যসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সামগ্রীর দাম বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধর্মীয় কোনো উৎসব উপলক্ষে যেখানে পণ্যসামগ্রীর দাম কমানো হয়, আর আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র পরিলক্ষিত হয়। এখানে বাড়তি মুনাফায় ভোক্তার পকেট কেটে পকেটস্থ করার দুরভিসন্ধিতে ভোক্তাদের জিম্মি করে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, যা ব্যবসায়িক নীতি নৈতিকতা পরিপন্থি ও অগ্রহণযোগ্য হলেও এটিই এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।
আপনাদের সবার মনে থাকার কথা বিগত রমজানের ১৫ তারিখের পর কোনো কারণ ছাড়াই ভোজ্যতেল আমদানিকারক, মিল মালিক ও পাইকারি বিক্রেতারা বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ করে দেন। বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে চরম সংকট তৈরি হয়। ঈদের পরে যে দিন অফিস শুরু হলো সেদিনই ৩৮ টাকা প্রতি লিটারে দাম বাড়িয়ে নেন। আর নতুন দামে পুরানো মজুত তেল বিক্রিতে মরিয়া হন ব্যবসায়ীরা। পরে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পানের দোকান, গ্যারেজ ও সুরঙ্গ থেকে সয়াবিন তেলের খনি আবিষ্কার করেছিলেন। আর এ সময়ে বাজারে সয়াবিন তেল উধাও। সয়াবিন তেল নিয়ে মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের বিচিত্র চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আবার অনেকে তেল ছাড়া রান্নায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ভর্তি হওয়ার মতো ঘটনার উদ্ভব হয়। যদিও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ওই সময়ে যে পরিমান সয়াবিন আমদানি হয়েছে তা দিয়ে পুরো বছরের তেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। তাহলে ভোজ্যতেল আমদানিকারক, মিলমালিক ও পাইকারি বিক্রেতাদের জনগণকে জিম্মি করে পকেট কাটার এই উৎসব বন্ধে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া ত্রাণকর্তা হিসেবে আর কাউকে পাওয়া যায়নি।
ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, করোনা অভিঘাত মোকাবিলা পরবর্তী সময়ে মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের মধ্যে একটা বড় ব্যবধান রচিত হয়েছে। একারণে দৃশ্যত বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি, অভাব না থাকলেও মানুষ তা কিনতে পারছে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা সামর্থ্যের অভাবই এখানে প্রধান। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দৈশিক ও বৈশ্বিক কারণ যাই হোক, তা এতোটা বাড়ার কথা নয়। যদিও ব্যবসায়ীদের সুরে সরকারের একশ্রেণির কর্তারা মূল্যবৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক নানা যুক্তি দাঁড় করান। কিন্তু আমাদের দেশীয় কৃষি উৎপাদনে উৎপাদিত বা অনেক আগে আমদানিকৃত পণ্যও হুহু করে দাম বাড়ানোর বিষয়টি কোনোভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে না। তাই বলতে দ্বিধা নেই, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ও বাড়ছে জনগণের পকেট কাটার উৎসবে মাতোয়ারা এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ও অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ীর নীতিহীনতার কারণে। বলা বাহুল্য, নিত্যপণ্য মূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ও প্রান্তিক পর্যায়ের সাধারণ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তা এতটাই শোচনীয় যে, ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সাধারণ ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও জীবন-জীবিকা নিয়ে দিশাহারা অবস্থায় পতিত হয়েছে। করোনার কারণে অধিকাংশ সাধারণ মানুষের অনেক আগে থেকেই নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। এর বাইরে সাম্প্রতিক সংগঠিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্য পরিস্থিতিকে রীতিমত ভয়াবহ অবস্থায় নিয়ে গেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ নিত্যপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া ত্রাণকর্তা হিসেবে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ, ভোক্তা ও বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে নিত্যপণ্য বাজারের উপরই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ বরাবরই বলবৎ ছিল এবং আছে। চাল, ডাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপণ্য ও সেবা নেই, যার দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী রশি টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। সয়াবিন তেলের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ভোজ্যতেলের দাম আমদানিকারক, মিলমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দফায় দফায় বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা তাদের ইচ্ছামতো করে বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সরকারের নির্দেশনা, কথা, হুমকি-ধমকি তারা কোনোভাবেই আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকারই ভোজ্যতেলের আমদানি ভ্যাটমুক্ত করে দিয়েছে। বাজারে এরও প্রতিফলন দেখা যায়নি। অধিকিন্তু নতুন করে দাম আরও বেড়েছে। শুল্ক কমানোর পর তাদের বক্তব্য ছিল পরে ধাপে যখন আমদানি হবে তখন শুল্ক হ্রাসের বিষয়টি কার্যকর হবে। অথচ আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশি ওই পণ্য আমদানি না হলেও দাম বাড়িয়ে দেন। আর আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম কমা বা শুল্ক হ্রাস করা হলে বলেন বেশি দামে কেনা। আবার অনেক সময় ব্যবসায়ীরা বড় গলায় বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকার। এর বাইরে আবার কিছু অর্থনীতিবিদও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের কিছু করণীয় নেই। সরকার কেন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে বাজারে হস্তক্ষেপ করবেন। তার অর্থ এটাই ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো দাম উঠানামা করাবেন, জনগণের পকেট কাটবেন, আর সরকারি লোকজন শুধুমাত্র দেখে থাকবেন। তাদের কথায় সায় দিতে গেলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে পোষার প্রয়োজন নেই। কারন গুটিকয়েক দুষ্ঠুলোক রাষ্ট্র ও আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কাজ করবেন। এখানে সরকার কেন হস্তক্ষেপ করবেন? তার মতো হবে।
গণমাধ্যমের কল্যাণে সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ৫০ টাকার নৌকার ভাড়া ৫০ হাজারে, ১০ টাকার মোমবাতি ১০০ টাকায়, ৫০ টাকার পাউরুটি ৫০০ টাকায় হাঁকার খবরে মানুষের বিবেক কোনোভাবেই নাড়া দেয়নি। ঠিক এভাবে দুর্গত মানুষকে চরম বিপদে রেখে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার ঘটনা পুরানো নয়। কোভিড-১৯ এর লকডাউন চলাকালেও কিছু মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটের পাশাপাশি ক্লিনিক ও হাসপাতালে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের দৃষ্টান্তও কম নয়। আর এসমস্ত ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসী ও অমানবিক মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে। তারা একটুখানি সুযোগ পেলেই এই সন্ত্রাসে নেমে পড়েন। তাদের এই অমানবিক আচরণকে ঘৃনা জানানো ছাড়া সাধারন মানুষের পক্ষে আর কিছুই করার থাকে না।
সহজ ও সোজা কথায় বলতে গেলে বাজারে আগুন লেগেছে ও অস্থিরতা চলমান। সেই আগুনে আমাদের বিবেক, মানবিকতা, আমাদের প্রশাসন এবং আমাদের রাজনীতি, সবকিছুই যেন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের সীমাহীন লোভ লালসার শিকার সাধারণ মানুষ।
এ দেশের রাজনীতি বর্তমানে আর রাজনীতিবিদরা পরিচালনা করছেন না। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। প্রমাণ হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় সংসদ সদস্যদের পেশার হিসাবনিকাশ দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে যদি ২০ ভাগ ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য হয়ে থাকেন তাহলে তা এখন ৮০ ভাগে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় সংসদ যেহেতু দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকেন। সেখানে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যরা সরকারের নীতি প্রণয়নে তাদের প্রভাব অবশ্যই একটি বিবেচ্য বিষয়। সেবার পরিবর্তে জাতীয় সংসদ সদস্যরা তাদের লাভ-লোকসানের হিসাব কষবেন এটাই স্বাভাবিক। আসলে নিত্যপণ্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া বেপরোয়াভাবে তছনছ করে দিচ্ছে জীবনযাত্রা। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে নিত্যপণ্যমূল্য বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অদম্য লোভ, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার সিন্ডিকেট। আর আইনপ্রয়োগে নিয়োজিত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন নিজেদের চাকরি বাঁচাতে এবং আখের গোছাতে জনগণের প্রয়োজনের সময়ে নিরবতা পালন ও নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততা করে ব্যবসায়ী তোষণনীতি অবলম্বন করে যাচ্ছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঈদ, পূজা, উৎসব-পার্বণ উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয় নিত্যপণ্যে ও অন্যান্য সামগ্রীতে। দাম কমানো হয় পণ্যসামগ্রীর। সেখানে আমাদের দেশে তার বিপরীত চিত্র। উৎসব-পার্বণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। নানা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারী করছে। ভোক্তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়, ঠকানো হচ্ছে অনবরত। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে অসাধু ব্যবসায়ীদের যে কারসাজি শুরু হয়েছে, তা নিতান্তই অন্যায়, অনৈতিক ও অযৌক্তিক হলে নীতি নির্ধারক মহল এই কঠিন সময়ে একে বারেই চুপ থাকবেন। তবে আমাদের প্রত্যাশা এই অপতৎপরতা অবশ্যই রুখে দিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বশীল মহল সোচ্চার হবেন। কারণ দেশের ১৮ কোটি মানুষের করের টাকায় সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীর বেতন ভাতা ও যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। শুধুমাত্র গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীদের করের টাকায় না। আর ব্যবসায়ীরা যদি কর দিয়েও থাকেন সেই টাকা জনগন থেকে আহরণ করে দেওয়া। তাই আমরা বিশ্বাস করতে চাই যার নুন খাবেন, তারগুণ একটু করে হলেও গাইতে হবে। সাধারণ মানুষের স্বার্থ (যার মধ্যে ওই সরকারি কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও আছেন) ও অধিকার নিশ্চিতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা নিষ্ঠা ও সততার বলিষ্ঠ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে কাজ করবেন। তাহলে গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠিন পরিস্থিতি থেকে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের সামলানো যাবে, যার দিকে তাকিয়ে আছেন ১৮ কোটি সাধারণ ভোক্তা।
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ই-মেইল:cabbd.nazer@gmail.com
আরএ/