ঢাকার জলজট ও বায়ুদূষণ
রাজধানী ঢাকা শহর অনেক আগেই চারশ বছর অতিক্রম করেছে। অসংখ্য ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক এ নগরীকে ঘিরে রয়েছে চারটি বহমান নদী। নদীগুলো যথাক্রমে— বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী। এই চারটি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার।
বিশ্বের খুব কম শহরই আছে এমন চারপাশ নদীবেষ্টিত। এ নদীগুলোর সঙ্গে ঢাকাবাসীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অনেকটা হরিহর আত্মার মতো। একসময় এই নদীগুলো জাগ্রত করে রেখেছিল বেশকিছু খাল-নালা। এ রকম প্রায় ৪৩টি ছোট-বড় খাল একসময় ঢাকা নগরীর বুক চিরে প্রবাহিত হতো। অতি বৃষ্টিতেও তখন শহরবাসীকে নাকাল হতে হয়নি। অনবরত ভারী বর্ষণ মহানগরীকে জলাবদ্ধতায় কাবু করতে পারেনি। খালগুলোর বদৌলতে পানি মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ছে।
সে সুসময় এখন আর নেই। যেমন নেই খালগুলো। নেই আধুনিক শহরের উপযোগী পরিকল্পিত সুয়ারেজ বা ড্রেনেজ ব্যবস্থাও। পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই জল নিষ্কাশন লাইন ও বক্স কালভার্ট। তাছাড়া বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি তো রয়েছেই। এতে করে ভারী বর্ষণ হলেই মহানগরীর পিচঢালা সড়কগুলো জলে টইটম্বুর হয়ে পড়ে। দু-চার প্রজাতির মাছ কিলবিল করতে দেখা যায় তখন। জলজটের কারণে এ সময় আর শহরবাসীর ভোগান্তির শেষ থাকে না। রিকশা কিংবা যান্ত্রিক যানের গতি থামিয়ে দেয় অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা। কর্মব্যস্ত মানুষকে তখন পড়তে হয় চরম বিপাকে। গাড়ির ইঞ্জিন বিগড়ে যাওয়ার ফলে সর্বসাধারণকে আরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ সময় রিকশা ভাড়াও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে গিয়ে কর্মজীবীদের বেকায়দায় পড়তে হয় তখন। এ ছাড়াও সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কর্তৃপক্ষের তপ্ত বাক্যবাণও হজম করতে হয়।
এটি শুধু সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণের চিত্র নয়, সবসময় এ ধরনের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। রাজধানীতে অতিবৃষ্টি হলেই এ সমস্যায় পড়তে হয় মানুষকে। অতি বর্ষণের ভোগান্তির চিত্রে আমরা প্রায় দেখি রিকশা উপুড় হয়ে পড়ে যাত্রীদের জলে গড়াগড়ি খেতে। নারী যাত্রীদের ক্ষেত্রে এ দুর্ভোগের চিত্র বড়ই করুণভাবে ফুটে উঠে। সেই চিত্র আবার ফেসবুকে ভাইরাল হতেও দেখা যায়। এসব ভোগান্তির চিত্র দেখে আমাদের যেমন খারাপ লাগে, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে আমরা অনেকটাই হেয় প্রতিপন্ন হই। এভাবে বাইরের রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া বা রাজধানীবাসীর ভোগান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে দূরদর্শীতার অভাব অথবা পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে না উঠার কারণ। সত্যি কথা বলতে আমাদের রাজধানী শহর চারশ বছর অতিক্রম করলেও এখনো আদর্শ নগরী হয়ে উঠতে পারেনি ড্রেনেজ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে; আরও কিছু কারণও রয়েছে অবশ্য। সে কারণগুলো এই লেখার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত নয় বিধায় আপাতত তা বিশ্লেষণ করা থেকে বিরত রইলাম আমরা। আমরা এখন ফিরে যাচ্ছি জলাবদ্ধতার বিষয়ে।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থায় রয়েছে দূরদর্শীতার পরিকল্পনা। ফলে অতি বর্ষণে তাদের শহর জলাভূমিতে রূপান্তরিত হয় না, জল জমলেও দ্রুত তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রয়েছে। আসলে দূরদর্শী পরিকল্পনার সুবাদেই তারা আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছে। অপরদিকে, মাস্টারপ্লান যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় আমরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
রাজধানীর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বস্তি। যার কারণে পরিকল্পিত নগরী গড়তে বড় ধরনের বাধার সন্মুখীন হতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। বিষয়টি দৃষ্টিকটু হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বছর খানেক আগে বলেছিলেন (৩ আগস্ট, ২০২১ সালের গণমাধ্যম মারফত জানা যায়), ‘বস্তি ছেড়ে গ্রামে ফিরলে জমি-ঘর-খাবার ইত্যাদির সুবিধা প্রদান করা হবে।’ আসলেই তিনি রাজধানীর উন্নয়নের লক্ষ্যেই এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, মূলত একটি দেশের সংস্কৃতি এবং রাজধানীই সে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ করে রাজধানীর পরিবেশ চাল-চিত্রই বহিবিশ্বে সবার আগে ফুটে উঠে। কারণ বিশ্ব গণমাধ্যম কিংবা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের আগমণ সবসময় রাজধানী কেন্দ্রিক হয়। সে বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাথায় নিয়েই বস্তিবাসীকে গ্রামমুখী হতে আহ্বান করেছেন।
রাজধানীর উন্নয়নের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের পাশাপাশি রাজধানী কর্তৃপক্ষ আরেকটু উদ্যোগী হলে নগরবাসীকে জলজট থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দিতে পারেন বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। প্রথমত, পয়োঃনিষ্কাশন বা ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে। দ্বিতীয়ত, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে ভালো মতো খনন করে জলপ্রবাহের গতি বাড়িয়ে। তৃতীয়ত, বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রেখে। এ তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি না দিলে নগরবাসীকে কোনোভাবেই জলজট থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না।
শুধু জলজটই নয়, আমাদের রাজধানীর আরও কিছু বদনাম রয়েছে। যেমন— জলজট, জনজট, যানজট, বায়ুদূষণ ও বস্তির নগরী হিসেবে পরিচিতি মিলছে ইদানীং। এ বদনাম থেকে সহজেই কেটে উঠার সম্ভাবনাও আমরা দেখছি না, বরং দিন দিন তা আরও বাড়ছে। প্রতিবছর রাজধানীতে ১০ শতাংশ হারে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে রাজপথ অচল করে দিচ্ছে। পাশাপাশি যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নিঃসরণের ফলে কার্বনের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল বারবার ঢাকা শহরকে সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছে। সে সতর্কবার্তা আমরা এখনো বিবেচনায় নিতে পারিনি। কিংবা বিবেচনায় নিলেও রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধের ব্যাপারে আমরা এখনো তৎপর হতে পারিনি। অথচ এটি হওয়ার কথা নয়, রাজধানীর পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সবার আগে নজর দেওয়া উচিৎ আমাদের। কারণ রাজধানী হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের মস্তকতুল্য। সেই মস্তকে পচন ধরলে দেহের অন্যান্য অঙ্গশোভা বৃথাই বলা যায়। সুতরাং রাজধানীর বায়ুদূষণ ও জলাবদ্ধতার বিষয়ে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে বহিবিশ্বের কাছে আমরা আরও হেয় প্রতিপন্ন হয়ে পড়ব। আর রাজধানী শহরও কার্যত অচল হয়ে পড়বে। তাই সময় থাকতে এক্ষুনি নগর পরিকল্পনায় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের, নচেৎ মহাদুর্যোগ নেমে আসবে রাজধানীতে, যা সামলানো তখন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ু বিষয়ক কলামিস্ট
আরএ/