প্রমত্তা পদ্মার বুকে দক্ষিণের দ্যুতি
স্বপ্নের দুয়ার অতিক্রম করে দক্ষিণে পৌঁছে গেছে আলোর দ্যুতি। এক সময় এই প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে কতো প্রাণের, কতো বুক ফাঁটা আর্তনাদ স্বচক্ষে স্বজনদের দেখতে হয়েছে। সেই নীল কষ্ট থেকে রেহাই পেল দক্ষিণাবাসী। কয়েকদিনে মানুষের উল্লাস দেখেছি, অতি উৎসাহী জনগণের ভ্রান্তি নিয়েও ট্রল কম হয়নি। পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর হিংস্রতা দমানোর জন্য নদী শাসন ও নদী ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সিগনেচার ব্রিজ।
বিশ্বের ১২২তম দীর্ঘ সেতুর পুরো নাম পদ্মা সেতু। আমাজানের পর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার উপর সেতুর স্থায়িত্ব ১০০ বছর। দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ১০০ বছরের স্থায়িত্বের জন্য পদ্মা সেতুর ডিজাইন করা হয়েছে। পদ্মা সেতু জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এ সেতুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হাতছানি দিচ্ছে ইতিবাচকভাবে। দক্ষিণ –পশ্চিমের ২১ জেলায় অর্থনীতির গতিতে নতুন নতুন পালক যুক্ত হবে এটা নিশ্চিত। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ সমস্ত জেলায় সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দুয়ার খুলে দিয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বলতে পারি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের একটি জরুরি অবকাঠামো এটি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পালক মেলবে নতুন নতুন খাত। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্কসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু সংলগ্ন জাজিরার নাওডোবা এলাকায় শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকার জীব বৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংগ্রহের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ— পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘরে এখন প্রাণী জগতের মিলনমেলা। দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই প্রাণী জাদুঘর শুধু বিনোদনই নয় গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
আর্থ সামাজিক উন্নয়নের করিডরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লক্ষ কোটি বাঙালির আবেগ ভালোবাসা ও স্বপ্ন। স্বপ্নের সেতু দিয়ে স্বপ্ন যাবে বাড়ি। দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জোয়ার বইবে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। যমুনা ও পদ্মা দুটি নদী একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগের নতুন মাত্রা যুক্ত হলো রাজধানীর সঙ্গে। এ সেতু ঘিরে সাধিত হয়েছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। সংযোগ সড়কের পাশাপাশি সার্ভিস এলাকায় নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো, সেতুতে রাখা হয়েছে গ্যাস সঞ্চালন লাইন, ফাইবার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট। সেতুর ভাটিতে তৈরি হচ্ছে হাই ভোল্টেজ বিদ্যু লাইন। টোল প্লাজার আনুষ্ঠানিকতা শেষে পদ্মা পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৬ মিনিট। এ সেতুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মা সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে নান্দনিক এই মহাসড়ক। নতুন দিগন্তে ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি, পর্যটনসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। পর্যটনে ঘটবে যুগান্তকারী বিপ্লব। মানুষের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তনও ঘটবে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত এলাকার নদী শাসনের ফলে অনেক কৃষি জমি নদী ভাঙন থেকে রেহাই পেয়েছে। কৃষি ও শিল্পের বিকাশের ফলে মানুষের কাজের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু অবদান রাখবে। নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন— পদ্মা সেতু ঢাকা থেকে মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-পায়রা-কুয়াকাটা-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি ইকোনমিক করিডোর হিসেবে দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় সর্বোত্তম লাইফলাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে এ অঞ্চলকে দেখবো খুব শিগগিরই আশা করি। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইকোনমিক জোন ও শিল্প পার্ক গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর প্রভাব পড়বে এটা সহজেই অনুমেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দূরদর্শী নেতা। প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণ ছিল তাঁর একটি লালিত স্বপ্ন। ইস্পাত সম্পর্ক জোড়া লাগিয়েছে দুই পাড়ের বহু হদয়কে। শেখ হাসিনার অদম্য সাহসিকতায় জোড়া লেগেছে দেশের মানুষের স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা প্রমত্তা পদ্মার বুকে শোভা বাড়িয়ে প্রকৌশল জগতের এক অভিনব বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে, ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক সোনার বাংলায় রুপান্তরিত হবে। দক্ষিণের জেলায় অর্থনৈতিক মুক্তির আলো উন্মোচিত হয়েছে ২৫ জুন। করোনার ধাক্কা ও ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে দেশ যখন সংকটে ঠিক তখনই পদ্মা সেতু উন্নয়নের এক শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হলো। নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। এদেশের নিজস্ব অর্থায়ন, সক্ষমতায় গড়া, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, হার না মানা বিজয়ের গল্প থেকেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, অদম্য সাহসিকতা বাংলাদেশের সক্ষমতাকে সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পদ্মা সেতু একটি ঐতিহাসিক অর্জন, বিশ্বকে দেখিয়েছে নতুন চমক, বাঙালি জাতিকে করেছে আত্মপ্রত্যয়ী। আমরা বাংলাদেশিরা আজ আনন্দিত ও গর্বিত। উত্তাল পদ্মার বুকে নির্মিত সেতু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং স্থাপনা হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক