সাফল্য, সন্তুষ্টি আর সক্ষমতার সেতু
সরকারি প্রচারণা, মানুষের আগ্রহ আর পদ্মার দুই তীরের মানুষের চোখে প্রত্যাশা পুরণের আনন্দ পদ্মা সেতু নিয়ে।পদ্মা সেতু সংযুক্ত করছে পদ্মা নদীর দুই তীর। পদ্মা সেতু শুধুমাত্র গতিশীল নদীর উপর নির্মিত ঝুকিপুর্ণ সেতুই নয় এর নির্মাণ শৈলী,বিশালত্ব,ব্যয়বহুলতার সমস্ত দিক ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বিতর্কের সেতু।
১৯৯৮ সালে প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা শুরু। নির্মাণ শেষে সেতুর উদ্বোধন হলো ২০২২ সালের ২৫ জুন। সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণব্যয় ১২ হাজার১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, নদীশাসনে আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে এক হাজার ৭২১ কোটি ১০ লাখ টাকা, পরামর্শক ব্যয় এক হাজার ৯০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আর জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ব্যয় ছয় হাজার ৫৪০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এই ব্যয় যথার্থ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলবে অনেকদিন।
প্রথম থেকেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিরোধিতার অভিযোগ ছিল। বিরোধিতাকে পুঁজি করে পাল্টা আক্রমণও চলেছে, চলেছে কথার লড়াই। দেশীয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শক্ত অভিযোগ করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। আছে বাস্তব-অবাস্তব নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ। দফায় দফায় খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেশি টাকা ব্যয় এবং উচ্চহারে টোল ধার্য করার সমালোচনাও আছে। কিন্তু সব সত্ত্বেও পদ্মা সেতু এখন সরকারের সাফল্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকে এই সেতু নিয়ে অসংখ্য সংবাদ হয়েছে। লেখা হয়েছে বিস্তর সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়; নানাদিক থেকে করা হয়েছে বিশ্লেষণ। কতশত ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন যে প্রকাশিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব, ব্লগ মিলে কত খবরের উৎস হয়েছে পদ্মা সেতু। সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকে জানা যাচ্ছে পদ্মা সেতু নিয়ে গত কয়েক বছরে অন্তত আড়াই কোটি প্রতিবেদন হয়েছে। পদ্মা সেতুর পাইলিং, পিলার স্থাপন, স্প্যান বসানো সবকিছুই ছিল সংবাদ শিরোনাম। গুগলে ইংরেজি পদ্মা ব্রিজ নিউজ লিখে সার্চ দিলে এক কোটি ২৩ লাখ খবরের লিংক পাওয়া যায়। ইংরেজিতে শুধু পদ্মা ব্রিজ লিখলে ৬০ লাখ ১০ হাজার খবরের লিংক পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ছবি, ভিডিও, ওয়েবসাইট থাকলেও বেশির ভাগই পদ্মা সেতু নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ।
গুগলে বাংলায় পদ্মা সেতুর সংবাদ লিখে সার্চ দিলে ১৪ লাখের মতো খবরের লিংক পাওয়া যায়। আর বাংলায় পদ্মা সেতুর নিউজ লিখে সার্চ দিলে পাওয়া যায় ১৬ লাখ ২০ হাজার লিংক। শুধু পদ্মা সেতু লিখলে পাওয়া যায় ৩৬ লাখ লিংক। এই লিংকগুলোতে পদ্মা সেতু নিয়ে করা বিভিন্ন প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেতু নিয়ে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই বিশ্বের অন্যতম আলোচিত সেতু।
পদ্মা সেতুর টোল হার কেমন হবে তা নিয়েও বিতর্ক আছে। সেতুতে চলাচলকারি যানবাহনের টোল ধার্য করে প্রদত্ত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, মোটর সাইকেলের জন্য টোলের হার ১০০ টাকা; কার, জিপ ৭৫০ টাকা; পিকআপ ভ্যান ১ হাজার ২০০ টাকা; মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা; ছোট বাস (৩১ আসন বা তার কম) ১ হাজার ৪০০টাকা; মাঝারি বাস (৩২ আসন বা তার বেশি) ২ হাজার টাকা; বড় বাস (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ছোট ট্রাকের জন্য (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ১০০টাকা; মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা; বড় ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা; ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেলের অধিক) ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছাসের পর এই টোল হার নিয়ে আলোচনা আবার সামনে আসবে।
বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা ও জটিল প্রকৃতির নদী পদ্মা। এর বুকে সেতু নির্মাণও তাই জটিল কাজ। এ জন্য পদ্মাসেতুর তদারক থেকে শুরু করে নির্মাণ কাজ সম্পুর্ণ করা পর্যন্ত দেশের এবং বিশ্বের সেরা মেধাগুলোকেই যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বড় অবকাঠামো নির্মাণে অভিজ্ঞ বহু দেশের নাগরিকেরাই এ প্রকল্পে কাজ করেছেন, করছেন।
পদ্মা সেতু যেমন বহুমুখী সেতু তেমনি এর নির্মাণেও আছে বহুদেশ আর বহু মানুষের অংশগ্রহণ। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসন ও মূল সেতুর কাজে চার হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেছেন। এদের মধ্যে চীনের কর্মী আছেন এক হাজারের মতো। এ ছাড়া জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনও কাজ করেছেন।
পরামর্শক দলে কাজ করেছেন কমবেশি ১৪টি দেশের প্রকৌশলীরা। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি ও নেদারল্যান্ডস।
প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত স্টিলের সব কাঠামো চীন থেকে এসেছে। রেলের গার্ডার (স্ট্রিনজার) এসেছে লুক্সেমবার্গ থেকে। প্রকল্পে যত রড এবং সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়েছে, এর সবই বাংলাদেশে উৎপাদিত। তবে অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু অতি মিহি সিমেন্টও ব্যবহৃত হয়েছে। সংযোগ সড়কসহ কিছু স্থাপনা নির্মাণে মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি থেকে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে বেশির ভাগ পাথর ব্যবহৃত হয়েছে ভারত, দুবাই, ওমান ও ভিয়েতনামের।
পৃথিবীর বৃহত্তম ড্রেজার গুলোর মধ্যে তিনটি পদ্মা সেতুর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো নেদারল্যান্ডস থেকে আনা হয়। পাইল বসানোর জন্য হাইড্রোলিক হাতুড়ি (হ্যামার) এসেছে জার্মানি থেকে। সবচেয়ে বড় হ্যামারটির ক্ষমতা তিন হাজার কিলোজুল। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আনা যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হয়েছে। আর ব্যবহৃত বাকি সব যন্ত্রপাতি চীনের। বিভিন্ন সময় ১৭টি বড় বড় ক্রেন ও ভারী যন্ত্রপাতি একসঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেনটি প্রায় চার হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি দিয়েই ৩ হাজার ২০০ টন ওজনের ইস্পাতের স্প্যান বসানো হয়েছে। পদ্মাসেতু তাই আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও দক্ষতার এক সম্মিলনও বটে।
বাংলাদেশকে বলা হতো নদী মাতৃক দেশ। দেশ জুড়ে একে বেকে বয়ে যাওয়া শত শত নদীর দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এখন দেশের বুক চিড়ে অসংখ্য রাস্তা আর নদীর বুকে অসংখ্য সেতু। দেশকে এখন সেতু মাতৃক দেশ বললে কি অতিরঞ্জন হবে? বাংলাদেশের জনগনের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই জাতির অর্থনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরকারের দৃঢ়তা লক্ষ্যনীয়। নির্মাণের ক্ষেত্রে চীনের কারিগরি কুশলতা, পদ্মার মত গভীর, তীব্র স্রোত সম্পন্ন এবং ভাঙন প্রবণ নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করার দক্ষতা প্রশংসনীয় । সেতুর উপর চলবে গাড়ি, যদিও ভাড়া বাড়বে তবুও সহজ হবে মানুষের যাতায়াত, জিডিপিতে প্রভাব পড়বে এবং দেড় শতাংশ বাড়বে বলে হিসাব করা হচ্ছে। কিন্ত পদ্মা সেতু বৈষম্য কমাবে কি না সেকথা কেউ বলছেন না।
যমুনা সেতু হয়েছে কিন্তু উত্তরবঙ্গের কৃষকের দুর্দশা যেমন কমেনি পদ্মা সেতুর প্রভাব তেমন হোক এটা জনগন চায় না। পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্য সরকার দাবি করুক কিন্তু সুফল যেন জনগন পায় সেটাই তো কাম্য হওয়া উচিত। দৃশ্যমান সাফল্য স্থায়ী হোক সঙ্গে সঙ্গে জনগনের অদৃশ্য শত্রু শোষণ ও প্রকাশ্য ফলাফল যে বৈষম্য তা যেন দুরীভূত হয় সেটাই গণমানুষের আশা। সাফল্য যেন অহমিকায় পরিনত হয়ে প্রতিপক্ষকে না করে বরং জনগণের সন্তষ্টির অনায়াসেই চাওয়া কী একটু বেশি চাওয়া হবে?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)