পল্লী উন্নয়নে বিশ্ব কবির ভাবনা
রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ছিল গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার। জমিদারের সন্তান হয়েও ভাবনায় রেখেছিলেন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কল্যাণ। স্বনির্ভর গ্রাম প্রতিষ্ঠা ও গ্রামীণ অর্থনীতি পূর্নরুদ্ধারের ব্যাপারে কবির ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, আমার জন্মগত পেশা জমিদারী, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারী। জমিদারের সন্তান হিসেবে তিনি যতো না খাজনা আদায় করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যসুধা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। খেয়াপারের মাঝিটিকেও তিনি কাব্যিক ছন্দ দিতে ভুলেননি।
রবীন্দ্রনাথ পল্লী উন্নয়নকে একটি জাতির উন্নতির একমাত্র উপায় হিসেবে জেনেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতেন সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। পল্লী উন্নয়নের সুযোগ্য গবেষক ড. আনোয়ারুল করীম, তাঁর সমবায়ী রবীন্দ্রনাথ ও পল্লী উন্নয়ন গ্রন্থ পৃ,৯ এ উল্লেখ করেছেন- ’পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সমবায়কে চালিকাশক্তি মনে করলেও একে সংহত রুপ দেবার জন্য তিনি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে জোট বাঁধা, ব্যুহবদ্ধতা এবং অর্গানিজেশন এই তিনটি পল্লী উন্নয়নের সারকথা’।
সমবায়ভিক্তিক কৃষি ও শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সর্বক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন। সমবায়ের সাথে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার কবির পল্লী উন্নয়ন ভাবনার এক অভূতপূর্ব সংযোজন। গভীর থেকে গভীরতর চিন্তা চেতনা কবির হদয়কে ছুঁয়েছিল। সমবায়ভিক্তিক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রথম উদ্যোগী পুরুষ রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত পল্লী সমাজের কাঠামো অনেকটাই ইউনিয়ন পরিষদের আদলে সৃষ্ঠ। শিলাইদহ শাহজাদপুর,পতিসরের আশেপাশের দরিদ্র মানুষগুলোর অসহায়ত্ব তাঁর বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। কবির অন্তদ্ষ্টি ও সাহিত্য প্রতিভা গ্রামীণ মানুষের দূর্বিষহ জীবনকে উপলব্ধি করার সক্ষমতা বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল। গ্রাম বাংলার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগ ছিল প্রবল। গ্রামকে তিনি নারীর সাথে তুলনা করে বলেন’ Villages are like women, in their keeping is the cradle of the race’ ………………… কবিতা ও সাহিত্য কবিকে স্বদেশপ্রেমী করে তুলেছিল এবং সে কারণেই পল্লী উন্নয়নের চেতনা তাঁর অন্তর ছুঁয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্র ’১০ মে ১৮৯৩ সালে শিলাইদহে লিখেছেন’ এই দরিদ্র প্রজাগুলোকে দেখলে ভারী মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে- কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই ভুলে যায়।”
রবীন্দ্রনাথ অকপটে সাহিত্যচর্চায় গ্রামকে সামনে টেনে এনেছেন। কবির ধারনায় একটি গ্রাম জাগলে একটি দেশ জাগবে”। পল্লী উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ কবির এক যথার্থ প্রাণের তাগিদ। তিনি পল্লী উন্নয়ন বলতে পল্লীর সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নকেই বুঝেছিলেন। তিনি বর্ণ এবং শ্রেণী বৈষম্যকে পল্লী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় বলে মনে করতেন। তিনি পল্লীর মানুষের দূর্দশা দেখে পীড়িত হয়ে লেখেন; এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে।”রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ মানবতাবাদী এবং দেশপ্রেমী একজন রোমান্টিক কবি। তিনি প্রজাদের জনদরদী অভিভাবক ছিলেন তাঁর স্বপ্নই ছিল প্রজাদের উন্নয়ন। উপেনকে তিনি ধনী গরিব বৈষম্যের একটি চিহ হিসেবে সবার সামনে উত্থাপন করেছেন। তিনি পল্লী উন্নয়নকে স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের বুক থেকে কালোছায়া মুছে ফেলার মন্ত্রের দিক্ষা কবি বহু আগেই রপ্ত করছিলেন । খাদ্য সমস্যা দূরীকরণে তিনি কৃষকদের নিয়ে চাষবাস ও গোরুপালনের উপর জোর দিয়েছিলেন। এর ফলে কৃষকেরা লাভবান হয়েছিল। পল্লী উন্নয়নে বিশ্বকবির সুদূরপ্রসারী চিন্তা চেতনা আজও ভারতবর্ষে সমুজ্জল হয়ে রয়েছে।
চলবে…