বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান
সিলেট অঞ্চলে ১২২ বছরের মধ্যে এমন বন্যা আর হয়নি। এই এলাকার প্রায় সব জায়গায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও থাকার সংকটে দিশেহারা মানুষ হয়ে পড়েছে একেবারে অসহায়।
শুধু সিলেট নয়, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ অঞ্চলেও বন্যা দেখা দিয়েছে। তুমুল বৃষ্টির কারণে ইতোমধ্যে ভারত ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ খুলে দিয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলেও বন্যা এগিয়ে আসছে। প্রায় সব গণমাধ্যমে এমন নানা উদ্বেগজনক খবরে মনে হয়, আরেকটি বিপদের মধ্যে আমরা পড়েছি!
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনিতে, ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এ তথ্য আছে জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচের ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। তার উপর ভাটির দেশ হিসেবে সীমান্তের ওপার থেকে ধেয়ে আসা বাড়তি ঢল, নদ নদীর স্ফীতবস্থা এবং এখানে অবাধ পানি প্রবাহে নানা প্রতিবন্ধকতা দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলে আসাম, মেঘালয়ে এখন যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাও নাকি ১২২ বছরেও হয়নি। ওই অঞ্চলে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছে। ভাটির দেশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উপর। তবে হঠাৎ করে সিলেট অঞ্চলে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণ শুধু তুমুল বর্ষণ নয়। আসাম মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকার গাছপালা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগে এই এলাকার বাড়ি-ঘর ছিল খড়ের। এখন বেশিরভাগ টিন বা ইট পাথরের। এতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে আসছে। তাই আগামিতেও এরকম বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নদ-নদী পলিতে ভরে গেছে। নিয়মিত খনন না করায় বাড়তি পানি ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া হাওর অঞ্চলেও অবাধ পানি প্রবাহ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওরে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ’অলওয়েদা’ সড়কটি পর্যটন বান্ধব হলেও বন্যার পানি নিষ্কাশনে বাঁধা হয়েছে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রায় ৩০ কিলোমিটারের এই সড়কটির পানি চলাচলের পথ মাত্র ৯০০ মিটারের। এতে পানি আটকে থাকায় ফসলও নষ্ট হচ্ছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ’অলওয়েদার’ সড়কটি কেটে সেতৃর সংখ্যা বাড়িয়ে পানি প্রবাহ বাড়ানো যায় কিনা তা খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে, পরিবেশগত বিষয় বিবেচনা ছাড়াই এত বড় একটি সড়ক নির্মাণ কি করে হলো? তা ছাড়া হাওরের নানা স্থানে তৈরি করা হচ্ছে খামারসহ নানা স্থাপনা। এতে ভবিষ্যতে পানির অবাধ প্রবাহের এই হাওর টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
এই সর্বগ্রাসী বন্যার ফলে মানবিক সংকটেরও সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বন্যার্তদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে অবশ্য প্রবাসীসহ অনেকের এগিয়ে আসার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে।
বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। বিশেষ করে রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘরসহ নানা স্থাপনা পুননির্মাণে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।
নদী বিধৌত পলিমাটির দেশ হিসেবে এখানে ফি বছর বন্যা আসবেই। এটাই এদেশের নিয়তি। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এর প্রকোপও বেড়ে গেছে। তাই বন্যার সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন। যাতে বন্যায় যত কম ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি নিশ্চিত করা যায়।
লেখক: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/