পদ্মার ঢেউয়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা
পদ্মার ঢেউ রে-
মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে….
প্রমত্ত পদ্মাকে নিয়ে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের এই গানটি অনেকের প্রিয়। এরকম আরও নানা গান, কবিতা, গল্প উপন্যাস রচিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এই বিশাল নদীটি এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। কখনো কখনো এর ভয়াবহ রূপে অনেকে হয়েছে সর্বস্বান্ত। আবার একে আঁকড়ে ধরেই তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। জীবনকে এগিয়ে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত ভাঙা-গড়ার এই খেলায় দুই পাড়ের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দু:খ- বেদনা, সুখ-আনন্দ এই নদীর স্রোতের মতই বহমান।
পদ্মার চলার পথ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নাটকীয়। আর গঙ্গা ও পদ্মাতো এক অর্থে একই নদী। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে জন্ম নেয় গঙ্গা নদী। এটি ভারতের প্রধান ও পবিত্রতম নদী। আছে ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গান-
বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি
গঙ্গা বইছো কেন…
ভারতে এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫২৫ কিলোমিটার। বিহারের রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের কাছে এই নদী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। মূল শাখাটি পদ্মা নাম নিয়ে রাজশাহীর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। অপর শাখাটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে ভাগীরথী-হুগলি নাম নিয়ে।
পদ্মার এই বৈচিত্র্য তার খরস্রোতা গতি প্রবাহেও বিদ্যমান। এজন্য সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে বহু ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। পাইলিং করার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার তৈরি করতে হয় জার্মানিতে। এরপর এটি এখানে নিয়ে এসে এই কাজে ব্যবহার করা হয়। পদ্মা সেতুর এক একটি পিলারের উচ্চতা নদীর তলদেশে ৪০ তলা ভবনের সমান। এ ছাড়া নেদারল্যান্ড থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিনটি ড্রেজার এই সেতুর কাজে আনা হয়।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে নির্মিত অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য ১২.২ কিলোমিটার। দ্বিতল এই সেতুর উপরে চলবে গাড়ি, নিচে রেল। প্রায় চার হাজার শ্রমিক এই সেতু নির্মাণে কাজ করেছেন। এর মধ্যে চীনের এক হাজার। বাকিরা বাংলাদেশের। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের কিছু বিশেষজ্ঞও আছেন। আর পরামর্শক দলে কাজ করেছেন বাংলাদেশ ছাড়াও ১৪টি দেশের প্রকৌশলীরা।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় ৩০,১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ১২,৪৯৩ কোটি টাকা, নদী শাসনে ৮,৯৭২ কোটি টাকা, ভূমি অধিগ্রহণ-পরিবেশ ও পুনর্বাসন ব্যয় ৪,৩৪২ কোটি টাকা, সংযোগ সড়ক ১,৫০০ কোটি টাকা, পরামর্শকসহ অন্যান্য খাতে ২,৮৮৫ কোটি টাকা। টোল আদায়ের মাধ্যমে আগামী ১৭ বছরে এই নির্মাণ ব্যয়ের সবটাই উঠে আসবে। দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তনসহ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আরও উন্নতি নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।
দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ সুযোগ পেয়েছে তার সামর্থ্য প্রমাণে। আগামী ২৫ জুন বর্ণাঢ্য-স্মরণীয় উদ্বোধনে অবসান হবে কোটি কোটি মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগ, একই সঙ্গে স্বপ্নের বাস্তবায়নও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে, নিজস্ব অর্থায়নে, এই সেতু নির্মাণের মধ্যে দিয়ে এই দেশ, এই দেশের মানুষ তার আত্মমর্যাদাকে তুলে ধরতে পেরেছে। এই গৌরবের অংশীদার হয়ে এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের দিকে আরও এগিয়ে যাবে—এটাই এখন পরবর্তী সাফল্যের মূলমন্ত্র।
ইব্রাহিম আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/