পররাষ্ট্রনীতির সূচনা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই
আমরা আজ স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীও উদযাপন করছি। সুতরাং বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কতটুকু সফলতা অর্জন করেছে এবং কোন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারেনি, সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে একটা মূল্যায়ন যদি করি, সেটা যুক্তিযুক্ত ও সময়োপযোগী হবে।
৫০ বছর একটা জাতির জন্য যদিও অনেক লম্বা সময় নয়, তবুও আমরা প্রজন্মগত দিক থেকে যদি দেখি, আমরা যারা এটা নিয়ে গর্ববোধ করি, আমাদের অবশ্যই ভিন্ন একটি অনুভূতি আছে। আমরা যদি ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই শুরু করি, তাহলে দেখা যায়, আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার চেয়েছিলাম। সেই গণতান্ত্রিক অধিকার না দিয়ে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। একটা হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল।
সেই বক্তব্য মানুষের কাছে তুলে ধরাই আমাদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সেটি প্রতিরোধ (যুদ্ধ) করেছি গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য। আমরা সমষ্টিগতভাবে এদেশের সব শ্রেণি-পেশার, ধর্ম-বর্ণের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি। বিশেষ করে ২৫শে মার্চের ঘটনার পর স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছি নিজেদের স্বকীয়তা প্রকাশের জন্যই।
বিষয়গুলি বিশ্বের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। আমরা বলতে পারি, সেই থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু। তারপর যখন ঘটনা প্রবাহে আমরা আমাদের অবস্থানের কথা বলার চেষ্টা করছিলাম, তখন পাকিস্তান-ভারত এ বিষয় দ্বিপাক্ষিক ফ্রেমে ফেলে ইন্দোপাক কন্টেস্টে নিয়ে গেল। আমরা নিজেরা তখন হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছিলাম। আমরা যে স্বাধীনতা যুদ্ধ করছি, সেই বক্তব্য কোথায়? সেখানে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, আমাদের আত্মসম্মানবোধটুকু রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছি, সেই কথাটি প্রকাশ করা আমাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। সেটিই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রচেষ্টা পৃথিবীর কাছে আমাদের বক্তব্যটি তুলে ধরতে।
সে সময় এক কোটি মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতসহ অন্যান্য দেশ তাদের সাহায্য করেছে। সে সময় ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়েছিল। তাদের বোঝাতে হয়েছে, এসব মানুষ নিগৃহীত হয়ে তাদের কাছে এসেছে। তাদের সাহায্য প্রয়োজন। তারপর ভারত সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আবেদন-নিবেদন করতে হয়েছে আমাদের। অসহায় নিগৃহীত এসব মানুষের জন্য ভারতসহ অন্যান্য দেশের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। বলা যায় এটি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির পরবর্তী পদক্ষেপ। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রাথমিক গল্পটা এখান থেকেই শুরু।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য লড়ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ অথবা স্বাধীনতা যুদ্ধ যেভাবেই বলা হোক না কেন, পাকিস্তান এটিকে বলা শুরু করল কিছু বিভ্রান্ত যুবক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। সেখানে আমাদের জন্য দুটি ব্যাপার আছে। পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ। স্বাধীন দেশের কোনো অংশে যদি কেউ বিদ্রোহ ঘোষণা করে সেটা দমন করার সার্বভৌম অধিকার তাদের আছে। তারা সেই কথাটিই সারা পৃথিবীর কাছে বলা শুরু করল এবং তা ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখানো হলো। এটা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ কারণ ভারত আমাদের সাহায্য করছে; এটা মানবিক সাহায্য, হয়তো খানিকটা কূটনৈতিক সাহায্যও।
আমরা তো সংগ্রাম করছি আমাদের আত্মরক্ষার জন্য; আমার স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য এবং আমি ও দেশের মানুষ হচ্ছে আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক। ভারতসহ আমাদের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টাতে আমাদের সহযোগী হয়েছে। এখানে ভারত প্রধান ভূমিকা পালন করেনি, কোনো ষড়যন্ত্রও সেখানে প্রধান ভূমিকা পালন করেনি। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য আমরা সংগ্রাম করছিলাম। জাতি হিসেবে সমগ্র জাতি সংগ্রামে অংশ নিয়ে স্বাধীন দেশের ভিত্তিটা স্থাপন করেছি। সেই জায়গায় আমাদের অস্তিত্বকে বাইরে জানান দেওয়ার জন্যই কাজটা করতে হয়েছে এবং সেই সময় থেকেই কিন্তু হাঁটিহাঁটি পা পা করে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই পররাষ্ট্রনীতির শুরু।
সেময় বাংলাদেশ তার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে চেষ্টা করেছে, নিজেদের কথাগুলো বাইরের পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে।
পঞ্চাশ বছর পরে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করছি। ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণ বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সঙ্গে আমাদের বন্ধুরা যারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
এসএন/