প্রকল্প বনাম উন্নয়ন
কোভিড-১৯ বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বকে এক মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে সেই সঙ্গে হোঁচট খেয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। তবু ও উন্নয়নের পালকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দারুণ আলো ছড়িয়েছে। স্বস্তিও কিছুটা আছে, এক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নয়ন বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশের অর্জনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
ইদানিং বেশকিছু বিষয় পত্রিকাতে উঠে এসেছে তা হলো প্রকল্পের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ। ধরুন, একটা প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে যাকে প্রশিক্ষণ দিলে প্রকল্পের জন্য ভালো হবে সঠিক ব্যক্তিকে প্রকল্পের স্বার্থে প্রশিক্ষণে পাঠানো প্রয়োজন তাকেই নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় অনেককেই প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে দেশে ফেরার পর তাকে দিয়ে প্রকল্পের আর কোনো কাজেই সে আসে না অথবা অন্য কোনো দপ্তরে বদলি করা হয়, সেক্ষেত্রে অর্থ অপচয় এবং প্রকল্পের চরম ক্ষতি হয়। সমন্বয়হীনতা এবং অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের এই চর্চা রোধ করা জরুরি। সরকার ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা হলো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে বিদেশ সফর আর নয়, ব্যয় সংকোচন উদ্যোগের অংশ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্টায়াত্ব, স্বায়ত্বশাসিত ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ও একই আদেশ জারি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অহেতুক সম্পদের ব্যয় না করে সংরক্ষণ করতে হবে। বিশ্ব দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
প্রকল্পে দুর্নীতি একটি মারাত্মক ব্যাধি। কারণ উন্নয়নের সোপানে উঁই পোকার অস্তিত্ব থাকলে উন্নয়ন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাগজে শতভাগ কাজ কিন্তু মাঠ পর্যায়ে ধুলায় মিশানো প্রকল্প। সেখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন চরম ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এসব দুর্নীতিবাজদের কারণে। কাজের মান নিয়ে যেমন সংশয় তেমনি কিছু অসাধু কর্মকর্তারা বিল ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ করার পায়তারায় মত্ত থাকে। এক্ষেত্রে সমাজ, রাষ্ট্রকে ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার প্রশ্ন থেকে যায়। গোঁড়ায় গলদ বা শুরুতেই ভুল ব্যক্তিকে প্রকল্প পরিচালক পদে আসিন করে আমরা সঠিক প্রকল্প মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। আমি মনে করি এ ধরনের কর্মকর্তাকে হতে হবে সৎ, নিবেদিতপ্রাণ এবং মেধাবী। অত্যাধিক তদবির ও অর্থলেনদেনের ফলে নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক শুরুতেই প্রকল্পে যোগদান করে অর্থ আত্মসাতের প্রেরনায় পাবে। কারণ যে অর্থ দিয়ে সে এখানে ঢুকলো তার মাথায় থাকবে সে অর্থ পুষিয়ে নেবার।
প্রকল্প সময়মতো শুরু ও শেষ হতেও দীর্ঘমেয়াদী রশি টানতে হয়। আবার অনেক সময় অনেক প্রকল্পের অর্থব্যয় হয় না। এনিয়ে বিপাকে পড়তে হয় মন্ত্রণালয়গুলোকে। অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রকল্পের হাল এ রকম। প্রকল্পের ক্রয় থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালক ও জনবল নিয়োগ সুনির্দিষ্ট না করে তা এডিপিভুক্ত করে ফেলা হয়। এসব প্রকল্প পরে সংশোধন করে পাস করতে দীর্ঘমেয়াদী সময় পার করতে হয়। তড়িঘড়ি করে প্রকল্প দাখিল করে অনেকসময় ত্রুটি ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সংশোধনের জন্য সময়ক্ষেপন হয়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে তেমন কোন জবাবদিহি করতে হয় না। অবকাঠামোগত প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণেও সময়ক্ষেপণ হয়। এদিকে করোনার কারণে প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোও সঠিক সময়ে কর্মসম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ বা উৎপাদনমুখী নয়, সেগুলো এখন অনুমোদন করবে না।পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লিখেছেন ‘সোনালী যুগে খুব বড় আকারের বাজেট না করে মাঝারি ব্যয়ের রূপালি বাজেটের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণমান বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে’।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) সরকার চালু করেছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত। উন্নয়ন পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের বৃহৎ প্রকল্পগ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ। সে অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং সেলকে শক্তিশালীকরণ। প্রকল্পগুলো যাতে জনকল্যাণমুখী হয় সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নকে করতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ অধিকতর পিছিয়ে পড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলাগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে নগরায়নের উপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে আকাশচুম্বী প্রকল্প তবুও দুর্ভোগ থামেনি নগরবাসীর। বিষয় হিসেবে বলতে পারি সঠিক পরিকল্পনার অভাব। সমকাল পত্রিকায় ১৪ মে, ২০২২; ‘হাজার কোটি টাকা জলে!’ হতাশ হলাম বিষয়টি নিয়ে কারণ হিসেবে বলবো সেই অপরিকল্পিত ছক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এ বছর ও অবধারিতভাবে ডুববে রাজধানী, জলাবদ্ধতায় ভুগতে হবে কিছু এলাকার বাসিন্দাদের। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন করে থাকে। সেক্ষেত্রে আমি বলব প্রকল্প মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই বিভাগকে আরও জোড়ালো ভূমিকা রাখার প্রয়োজন। কারণ অনেকসময় দেখা যায় কাগজে প্রকল্প হয়ে যায় বাস্তবে প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে স্বস্ব বিভাগের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির উপর সবিশেষ জোর দিতে হবে। প্রতিটি কাজের দৃশ্যমান অস্তিত্ব যেন আমরা দেখতে পায়।
প্রকল্পের ধীরগতি আমাদেরও সহ্য করার গতি যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকল্প নকশায় দুর্বলতা বা শুরুতেই গলদের কারণে ভঙ্গুর প্রকল্প সামনে এসে দাঁড়ায়। এ ধরনের অব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। প্রকল্প এডিপিভুক্ত হবার পূর্বেই সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। সময়োপযোগী প্রকল্প নিতে হবে। যেটা জনগণের অধিক কল্যাণ সাধিত হয়। উন্নয়নে সমন্বয়হীনতা থাকলে পর্যদস্ত হবে অর্থনীতি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেগুলো দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। দেশি বা বিদেশি যে মাধ্যম বা উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে অবকাঠামো বা প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক না কেন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। অন্যথায় বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীলতার পরিবর্তে ব্যর্থতার ভারে ন্যুজ হতে হবে।
সম্প্রতি ঢাকা পাতালরেল (সাবওয়ে) প্রকল্প উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষসহ (বিবিএ) সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে, যাকে আন্তরিক ভাবে স্বাগত জানাচ্ছে আইপিডি (ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রকল্প লাভজনক বলে বিবেচিত না হলে প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়টি দেশের জন্য ইতিবাচক। এতে ব্যয়বহুল ও উচ্চভিলাষী প্রকল্পের জন্য অর্থ ও সম্পদের অপচয় থেকে দেশ রক্ষা পায়। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনার বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যবিহীন এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করতে যেয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের গুরুত্বপূর্ণ যে অর্থের অপচয় হচ্ছে তা রোধ করতে সরকারকে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। অযাচিত প্রকল্পগুলোকে লাগাম টেনে ধরার এখনি সময়। আমরা চাই না আমাদের জাতি হোক অর্থনৈতিক ঋণের ভারে ন্যুজ জাতি। মাথা উচু করে গর্বভরে আমরা বলতে পারি আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশি-কারো উপর হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা করে নয়, আমরা সুন্দর পরিকল্পনা করে পরিশ্রম করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক জাতি।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক