বৈশ্বিক সংকট, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ
টানা দুই বছর করোনা মহামারির ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই বিশ্ব এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী দেখছে এক যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ ধরনের পরিস্থিতি দেখার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। করোনার ধকল সামলাতে সব দেশই নানা পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট্ট দেশ ইউক্রেনের উপর জুলুমবাজি শুরু করল রাশিয়া। ছোট দেশের উপর বড় দেশের এই আগ্রাসী থাবা সবাই স্তম্ভিত। সবাইকেই এই পরিস্থিতি অস্বস্তিতে ফেলেছে। অথচ গোয়ারগোবিন্দ রাশিয়া কিছুই তোয়াক্কা করছে না। ইউক্রেনে অবাধ নারী-শিশু হত্যা করছে। উপাসনালয় কিংবা হাসপাতালও রাশিয়ার হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ কোন ধরনের গোয়ার্তুমি!
এখন যদি বিশ্বের সব বড় দেশ তার প্রতিবেশি ছোট দেশগুলোর উপর রাশিয়ার মতো আচরণ শুরু করে তখন কি হবে? কে কাকে ঠৈকাবে? তার মানে কি সব বড় দেশের আচরণ একই রকম? আজ কোথায় গেল মানবতার ধ্বজাধারীরা? তারা কেন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
বেশ কয়েকটি বড় দেশ রাশিয়াকে সমর্থনও দিচ্ছে। তারা কি কারণে সমর্থন দিচ্ছে তা বোধগম্য নয়। অবশ্য বড় দেশগুলো সব সময়ই সুযোগ খোঁজে। সুযোগ পেলেই তারা ছোট দেশগুলোর উপর আগ্রাসী হয়ে উঠে। ইউক্রেন ইস্যুতে অবশ্য জাতিসংঘসহ অধিকাংশ দেশই ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারপরও রাশিয়াকে থামাতে পারছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা ইউক্রেনে হামলা অব্যাহত রাখবে। আর এই অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিশ্বে খাদ্য সংকট মারাত্মক রূপ নেবে।
আমরা সবাই জানি, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসরমান দেশ ছিল শ্রীলঙ্কা। সেখানে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে উন্নতই ছিল। তাদের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে পর্যটন, চা ও তৈরি পোশাক। তাছাড়া বিদেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো অর্থও তাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু ভুল নেতৃত্ব, ভুল সিদ্ধান্ত এবং নেতৃত্বের দূরদর্শীতার অভাবে দেশটি বড় ধরনের বিপদে পড়েছে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে দেশটি। বড় সব প্রকল্পই বাস্তবায়ন করেছে চীন। তাছাড়া চীনের অর্থায়নে গভীর সমুদ্র বন্দর করে ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি বাড়িয়ে ফেলেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা বহন করতে অক্ষম শ্রীলঙ্কা। রিজার্ভের পরিমাণ একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কা নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।
শ্রীলঙ্কার এই করুণ পরিণতি দেখে কোনো কোনো বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলের নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। কেন তারা বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করছেন তা বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি চার হাজার ৪০৯ কোটি ৫১ ডলার। কিন্তু রিজার্ভের পরিমাণ সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার। চীনের থেকে ঋণের পরিমাণও খুব বেশি নয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের এমন অবস্থা হয়নি যে, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ। তাহলে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টানা হবে কেন? শুধুই কি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য? নাকি অন্য কোনো দুরভিসন্ধি আছে?
তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু ঝুঁকি আছে। সেই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করতে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে সরকারকে। বাংলাদেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে প্রধানত গম এবং জ্বালানি আমদানি করে থাকে। যুদ্ধের কারণে আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার। এ নিয়ে দেশের মানুষও টেনশনে আছে। কেউ কেউ হা হুতাশও করছে। তাদের ধারণা, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সারাবিশ্বই খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। চাইলেই বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে পারবে না।
এদিকে দেশে ডলার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এলসি করা ছাড়া ডলার মিলছে না। গত কয়েকদিন ধরে ডলারের বাজারে মারাত্মক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতেও অনেকে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করার পরপরই মার্কেট টালমাটাল হয়ে গেছে। এক ডলারের দাম উঠেছে ১০৪ টাকা। যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ অবস্থায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সরকার রেমিটেন্স প্রবাহ এবং রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। এছাড়া ডলার মার্কেটে স্থিতিশীলতা আসবে না। যদিও সরকার সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সরকারি সফরকে ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত করছে। এতে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অনেকেই আশা করছেন।
করোনার কারণে টানা দুই বছর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে। উন্নত অনেক দেশই অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যে এখনো সঠিক পথে আছে সেটা অনেক বড় অর্জন নয় কি? আরও আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ এখনো সন্তোসজনক পর্যায়ে রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক ভালো। তৈরি পোশাক খাতের আয় অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে ভালো। টানা কয়েক বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। ফলে বড় ধরনের সংকটে পড়ার আশঙ্কা আপাতত নেই। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সেই চ্যালেঞ্জ কিভাবে সরকার মোকাবিলা করবে সেটাই দেখার বিষয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর ভুলের কারণে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। এমনও কথা উঠেছে, তিনি ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী একজন ব্যবসায়ী। মন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রের সেবক। রাষ্ট্রের জনগণের ভালোর জন্য তাকে অনেক কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়। নির্মোহ হতে হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় মন্ত্রী হয়েও তিনি ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলেন। এ ব্যাপারে তাকে আরও সতর্ক হতে হবে।
করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আগামী এক বছর বা তারও বেশি সময় বিশ্বকে কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিশ্ব নেতাদের পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। যুদ্ধ নয় শান্তি এই স্লোগান নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক