সুসাংবাদিকতা ও সাহসিকতা
আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের যারা পূর্বসূরি ছিলেন, তারা ছিলেন আমাদের আদর্শ; তারা ছিলেন সৎ ও পরিশ্রমী সাংবাদিক। তখন মালিকেরাও একটা ভিশন নিয়ে সংবাদপত্র বের করতেন, তাতে সাংবাদিকেরাও আদর্শ নিয়ে
কাজ করতেন। মালিক ও সাংবাদিক উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সমন্বিত নীতি-আদর্শ ছিল, মহৎ দেশপ্রেম ছিল। এ কারণে তাদের অনেক সাহস ছিল। আদর্শ বা ভিশন বাস্তবায়নে তারা সাংবাদিকতা করতেন। এখন মিডিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছে, সাংবাদিক কমিউনিটিও অনেক বড় হয়েছে। পুঁজির আধিপত্যে সংবাদপত্রের মালিক বেড়েছে, সংবাদপত্রের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সাংবাদিক ও মালিকদের ভিতর মহৎ আদর্শের ভিত্তি ততটা পোক্ত হয়নি মনে হয়।
চারদিকে অবক্ষয়, অধ:পতন। সাংবাদিকতা তো বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ নয়। এটা সমাজেরই একটা প্রতিচ্ছবি। টোটাল ব্যবস্থার একটা পার্ট হলো সাংবাদিকেরা। আয়না যদি ভালো না হয়, তাহলে প্রতিচ্ছবি ভালো হবে ন। সমাজ, রাষ্ট্র যদি আয়না হয়, তাহলে সাংবাদিকরা প্রতিচ্ছবি। সমাজ, রাষ্ট্রসহ সর্বত্র যেখানে আদর্শের খরা বিদ্যমান, সেখানে সাংবাদিকদের উর্বর ভ‚মি হয়ে থাকা সহজ নয়। যার ফলে সাংবাদিকদের ভিতরও অবক্ষয় লক্ষ্যণীয়।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ, কর্পোরেট চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারপরও কিন্তু সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের উপর নির্ভর করতে চান। সাংবাদিকদের উপর আশা রাখতে চান। এটাই সাংবাদিকতার বড় শক্তি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণেই গণমাধ্যম মোকাবেলা করছে নানা ঝুঁকি। ঝুঁকি থাকবেই। একাত্তরে আমাদের ঝুঁকি ছিল। আমরা ঝুঁকি মোকাবেলা করেই সফল হয়েছি, স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ঝুঁকি ছাড়া সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা ছিল বাঙালির সাহসিকতা। সাংবাদিকতা ও সাহসিকতা একে-অপরের পরিপূরক, দুটো একসূত্রে গাথা, এ কথা মনে রাখা জরুরি।
সাংবাদিকদের সাহসিকতা যেমন জরুরি বিষয়, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তা ছাড়া সৎ-সাহসী সাংবাদিকতা সহজ নয়। একদিকে রাষ্ট্রকে সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানকেও চাকরি-বেতনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে সৎ-সাহসী সাংবাদিকতার প্রসার হবে।
অধিকাংশ সময় দেখা যায় রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ উভয়ের কাছেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন সাংবাদিকেরা। রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষ যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করে, তখন বাধ্য হয়ে গণমাধ্যমও ক¤েপ্রামাইজ করে। গণমাধ্যম যখন কম্প্রোমাইজ করে, তখন সংবাদপত্রের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। আরেকটা বিষয় হলো আগে সাংবাদিকদের ইউনিয়ন ছিল, সেটা ছিল দল-মত-নির্বিশেষে সবাই মিলে। ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসকের পতনের পর সাংবাদিকরাও রাজনীতিকভাবে বিভক্ত হয়ে যান। যার ফলে রাষ্ট্র বা কর্পোরেট হাউজগুলোও সাংবাদিকদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। এ অবস্থায় সুসাংবাদিকতা কিংবা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা সহজ নয়।
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সুসাংবাদিকতা বা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা আসলে আপেক্ষিক বিষয়। আপনার কাছে যেটা বস্তুনিষ্ঠ, সেটা আরেকজনের কাছে নাও হতে পারে। কর্পোরেট মিডিয়া বস্তুনিষ্ঠতা একভাবে দেখবে, আবার যারা রাজনৈতিক মুখপাত্র তারা আরেকভাবে দেখবে। আরেকটা হলো প্রফেশনাল মিডিয়া। যেটা সত্য, তারা সেটা লিখবে। তাদের কাছে এটা বস্তুনিষ্ঠতা। গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতার চর্চার বিচারক কারা? পাঠক বা জনগণ। জনগণের কাছে যা বস্তুনিষ্ঠতা, গণমাধ্যমের তা অব্যাহত রাখা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে তৈরি হয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি যেমন গণমাধ্যমের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে, আবার অন্যদিকে প্রযুক্তি অনেক সময় ঝুঁকিও তেরী করেছে। এখন প্রযুক্তির কারণে অত বেশি তথ্য রাখতে হয় না। আপনি চাইলে গুগলে গিয়ে বা ইন্টারনেটে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাবেন। সেটা শুধু দেশি না, বিদেশি রেফারেন্সও পাবেন। ফলে সাংবাদিকতায় এখন পরিশ্রমের প্রবণতা কমে গেছে অনেকখানি। ফলে নীতি-নৈতিকতায়ও একটা অবক্ষয় চলে এসেছে।
আমি যে অবক্ষয়ের কথা বলেছি, সেটার শিকার কিছু সংখ্যক সাংবাদিক হতে পারেন। কিন্তু এই পেশার শাশ্বত একটা আদর্শ আছে। অধিকাংশ সাংবাদিক সেই শাশ^ত আদর্শ হৃদয়ে ধারন করেন। যার ফলে সাংবাদিকতা এখনও মানুষের ভরসার প্রতীক।
লেখক: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক।