মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়ার সাতকাহন
বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের নানা ঘটনা প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম দখল করে থাকে। ভূ-মধ্যসাগরে দালালের খপ্পরে পড়ে কত বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেব আছে কিনা জানা নেই। ইউরোপ আমেরিকায় অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টায় বন জঙ্গলে অনেকের মানবেতর জীবনের সচিত্র প্রতিবেদনও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তারপরও সোনার হরিণের লোভে উন্নত দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টার কমতি নেই! এরইমধ্যে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাও চলছে!
শুধু রোহিঙ্গা নয় বাংলাদেশিদেরও মালয়েশিয়ায় পাচারের নানা ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে আমাদের জানা। কিন্তু দুই দেশের ইমিগ্রেশনের দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় জাল ভিসায় মালয়েশিয়ায় প্রেরণের অভিনব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হয়েছি!
ঈদের ছুটিতে মালয়েশিয়া ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরছিলাম ’মালিন্দো’ এয়ারলাইন্সে। রাতে কুয়ালালামপুর থেকে বিমানটি ছাড়ার পর দেখলাম দুই তরুণ বাংলাদেশি বিমানবালার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিমানবালারা মালয় ও ইংরেজি ছাড়া কিছু বুঝে না। আর ওই দুই তরুণ শুধু বাংলা বলতে পারে। অবশ্য আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতে সক্ষম হলো, তারা খাবার চায়! কৌতুহলী হয়ে তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে জানা গেল করুণ কাহিনী!
ওই দুই তরুণের এক জনের বাড়ি হবিগঞ্জে এবং আরেকজনের শরিয়তপুরে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দুই তরুণ জানাল, এর আগের দিনে রাতে তারা ঢাকা থেকে রওয়ানা দেয় এই এয়ারলাইন্সে। ভোরে কুয়ালালামপুর পৌঁছে। দালালের নির্দেশনা অনুযায়ী অপেক্ষা করতে থাকে বিমান বন্দরের পুলসিরাত পেরোনোর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বেরোতে পারে না। পরে মালয়েশিয়ান পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে বিমান বন্দরের লকআপ রুমে আটকে রাখে। তারপর থেকে তারা নাকি এক গ্লাস পানিও খেতে পারেনি। বিমান ছাড়ার আগ মুহূর্তে পুলিশ তাদের বিমানে তুলে দেয়। তাই বিমানে উঠার পর থেকে তারা খাবারের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল!
এবার আসা যাক তাদের এই বিড়ম্বনার আদ্যোপান্তে। তাদের দুইজনেরই ভাই ও অন্য আত্মীয় মালয়েশিয়ায় থাকে। তারাই তাদের অবৈধভাবে সেখানে প্রবেশ করানোর জন্য দালালের সঙ্গে চুক্তি করে। নারায়ণগঞ্জের মুজিব নামে এক দালালের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয় জনপ্রতি তিন লাখ টাকা করে দেওয়ার। বিমানের রিটার্ন টিকেট বাবদ অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ার বিমান বন্দর পেরোতে পারলে বাকি আড়াইলাখ টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করা হবে। এমন শর্তে ওই দুই জন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায়। সেখানে ওই দালালের নির্দেশনা অনুয়ায়ী বোর্ডিং পাস নিয়ে নির্দিষ্ট কাউন্টারে উপস্থিত হয়।
কাউন্টারে পাসপোর্ট দিয়ে দালালের দেওয়া কোড ‘সাগর’ বললেও সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার ডিউটি বদল হয়ে যাওয়ায় আমলে নেয়নি। পরে ওই তথ্য সঙ্গে সঙ্গে ওই দালালকে জানালে নতুন কোড ‘ঘূর্নিঝড়’ বলতে বলা হয়। আর তা বলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা সিল ছাপ্পর মেরে পাসপোর্ট দিয়ে দেয়। ভিসা আসল কি নকল তাও দেখা হয়নি, কোনো কিছু জিজ্ঞেসও করা হয়নি। আর তারা বিনা বাধায় জাল ভিসা নিয়ে বিমানে চড়ে বসে!
ওদিকে কুয়ালালামপুরে মালেয়শিয়ান সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সঙ্গেও দালালদের যোগসাজোশ রয়েছে। তারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জাল ভিসাধারীদের বিমান বন্দরের পুলসিরাত পার করে দেন। কোভিডের আগে এভাবে শত শত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা (বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী) মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট নেওয়া, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে দেওয়ারও আলাদা সিন্ডিকেট রয়েছে!
ওই দুই তরুণ দালালদের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কাউন্টার দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রেশন তাদের ভিসা জাল শনাক্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
কোভিডের সময় এখন মালয়েশিযায় প্রবেশ অনেক কড়াকড়ি হওয়ায় দালালদের সঙ্গে চুক্তি করেও সেখানকার সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আগের মত সবাইকে ’পার’ করে দিতে পারছেন না। আবার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে লেনদেনে বনিবনা না হওয়ায়ও শেষ পর্যন্ত অনেককে ফিরে আসতে হয়।
ওই দুই তরুণ জানায়, তিনশো রিঙ্গিত করে জরিমানা পরিশোধ করার পর তাদের ফেরত পাঠানো হয়। ওই দিন রাতে মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্সেও তাদের মত ১১ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। অন্য এয়ারলাইন্সেও প্রায় প্রতিদিনই অনেকে এভাবে ফেরত আসে।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে তারা যাতে বিপাকে না পরে সেজন্য ভুয়া ইন্দোনেশিয়ান ই ভিসা, টিকেটও দেওয়া হয়। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে ছাড়া পাওয়ার জন্য যাতে তারা বলতে পারেন, কানেক্টিং ফ্লাইটে তারা ইন্দোনেশিয়া যাবে!
এভাবে দালালদের নানা ছলচাতুরি, দুই দেশের দুর্নীতিবাজ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের যোগসাজোশে মানব পাচারের এই নিয়তির এবং হতভাগ্য বাংলাদেশিদের চরম দুর্দশা নিরসনের কি কোনো উপায় আছে?
লেখক: সাংবাদিক
আরএ/