একপেশে চিন্তা ও ঋণ শোধ না করতে পারার ফল আজকের শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কা সংকট বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল। গত কয়েক সপ্তাহে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। সেখানে মাহিন্দা রাজাপক্ষে তার কিছু অনুসারী, গুন্ডা প্রকৃতির লোকজনকে ব্যবহার করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মাহিন্দার পদত্যাগের পরও বিক্ষোভ থামেনি। জটিল এক পরিস্থিতির মুখে শ্রীলঙ্কা।
জনগণ এমনিতেই তাদের খাদ্যাভাব, বিদ্যুতের অভাব, নানা ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ প্রকাশ করছিল; কিন্তু যখন তাদের উপর সরকারি বাহিনী পুলিশের সহায়তায় আক্রমণ হয়, তখনই পরিস্থিতিটা পাল্টে যায়। শেষ পর্যন্ত মাহিন্দা রাজপক্ষে রাতের আধারেই রাজধানী থেকে দূরে একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও তার ছেলে বলেছেন যে, তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যে গুজব তৈরি হয়েছে যে, তিনি দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে।
সমস্যাটি যে পর্যায়ে আছে, বলা যেতে পারে–সরকারের নীতিগত দুর্বলতার কারণেই এটি ঘটেছে। রাজপক্ষে পরিবারের অন্তত ১৪ জন সদস্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। যে কারণে জনরোষ এই পরিবারের উপরই আবর্তিত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যা যেভাবে বিরূপ আকার ধারণ করেছে, নতুন সরকার এলেই যে তার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে জনরোষ যেটি আছে, সেটি কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, রাজাপক্ষে পরিবার কিন্তু ২০০৫ সাল থেকেই ক্ষমতায়। মাহিন্দা রাজাপক্ষে তখন প্রেসিডেন্ট। তিনি এবং তার ভাই দুজনে মিলেই কিন্তু তামিল বিদ্রোহ শক্তহাতে দমন করেন এবং তা ব্যাপকভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যার বিনিময়ে তা সংঘটিত হয়।
শ্রীলঙ্কাতে যা ঘটেছে এবং যে কোনো দেশে যে ঘটতে পারে, রাজাপাক্ষে এবং তার ভাই মিলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দাঙ্গা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছে। আজকের ঘটনা তারই ফলশ্রুতি। নিরীহ অসহায় জনগণকে হত্যার বিনিময়ে এরা তামিল বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ তামিলদের দাবি ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের; কিন্তু তার বিপক্ষে সব ক্ষমতা কলম্বোতে চলে যাওয়ার ফলে তামিল, মুসলিমসহ এরকম যারা সংখ্যালঘু ছিল তারা অসহায় হয়ে পড়ে এবং শ্রীলঙ্কার প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে না। তারই ফলশ্রুতিতে এর ফলে যেটা হয় সংখ্যালঘু দলগুলো একপেশে হয়ে যায়। আর এসবের মাধ্যমেই ২০১৯ সালে কিন্তু তারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। ২০০৯সাল পর্যন্ত তামিলদের একটা গ্রুপ তারপর ২০১৯ সালের পর থেকে শুরু হলো মুসলিমদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন। এখনকার যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সেটি তৈরির পেছনে এই কারণগুলো দায়ী।
এখানে আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, মাহিন্দ্র রাজাপক্ষের যে সরকার, তাদের কোনোরকম দায়বদ্ধতা ছিল না জনগণের কাছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলো থেকে অধিক পরিমাণে লোন নেওয়াসহ, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও বড় ধরনের দুর্নীতি ও বাইরে টাকা পাচারের বিষয়গুলো ঘটেছে। কাজেই একপেশে চিন্তাভাবনা ও ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারার ফল, স্বজনপ্রীতি ও জনস্বার্থ বহির্ভূত নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সরকার চালানোর ফলেই শ্রীলঙ্কা আজকের এই দুরবস্থায় নিপতিত হয়েছে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত
এসএ/