জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মনীষায় তিনি অনন্য ছিলেন
ভবিষ্যতের গবেষকেরা যখন বন্যা, খরা, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ আর দারিদ্র্যজয়ী আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের ইতিহাস লিখবেন— একজন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নাম ইতিহাসের পাতায় তারা হয়ে জ্বলবে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্বের একটি অর্থ মন্ত্রণালয় তিনি দেখতেন। হররোজ সমালোচকদের বিষোদগার শুনতেন। ‘রাবিশ’, ‘বোগাস’, ‘স্টুপিড’— বলে উড়িয়ে দিতেন। তীর্যক আক্রমণ করা গণমাধ্যমকেও। তবু বাংলাদেশে উন্নয়নের যাত্রাপথের সফল কাণ্ডারি হিসেবে ইতিহাসে তার নাম কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। ব্যাংকলুট, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির মতো প্রতারক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি যদি কঠোর ও অনমনীয় হতে পারতেন তবে তার সততা, দেশপ্রেম ও ব্যাপক পড়াশোনা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তুলনা করা যেত।
যাই হোক, এই সজ্জন মানুষকে আমার ভালো লাগতো নানা কারণে। তার সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে আমি তাকে একজন সুপণ্ডিত, বিদ্বান, শিল্পানুরাগী, ভাষাসৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সর্বোপরি একজন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধা করতাম। তিনি তার সময়ের সেরা মেধাবী ছিলেন। তাকে প্রথম দেখেছিলাম উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে (কেমুসাসে)। চার দলীয় জোটের সময়। আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে। আমরা তখন সিলেট সরকারি কলেজে পড়ি। একজন পাঠক হিসেবে নিয়মিত কেমুসাসে যাই। দেখতাম কবি কবি চেহারা নিয়ে কাঁধে একটি পাটের ব্যাগ ঝুলিয়ে জনাব মুহিত আসতেন বই লেনদেন করতে। সিলেট ছেড়ে যখন ঢাকায় আসি তখন বাংলা একাডেমি বইমেলায়ও তাকে নিয়মিত আসতে দেখতাম। এদেশে দ্বিতীয় কোনো মন্ত্রীকে আমি এতবার বইমেলায় আসতে দেখিনি। আর দেখব বলেও মনে হয় না। মন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর চলাফেরা করতে পারেন না তখন হুইল চেয়ারে করেও বইমেলায় গেছেন। পাঠক হিসেবে তিনি খুবই উন্নত রুচির ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ব্যক্তিগত একটি স্মৃতিচারণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। যথারীতি নিয়মিত অমর একুশে বইমেলায় যাই। ছাত্র হিসেবে যা হয় আমাদের পকেট শূন্যপ্রায়। ঘোরাঘুরি করি। মানুষ দেখি। নতুন বই কী এল না-এল নেড়েচেড়ে দেখি। তখনো বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয়নি। একদিন মেলা শুরু হওয়ার কিছু সময় পরেই দেখি অর্থমন্ত্রী মেলায় ঢুকেছেন। উনার হাঁটার মধ্যে একটু হন্তদন্ত ভাব থাকত। কৌতূহলী এক তরুণ হিসেবে আমি সেদিন উনার পিছু নিলাম। উদ্দেশ্য কী বই কেনেন দেখা। মিজান পাবলিশার্স নামে একটি প্রকাশনীতে ঢুঁ মারলেন। কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ ঢাউস সাইজের একটি রাজনৈতিক বই তার হাতে তুলে দিলেন। তিনি একটু নেড়েচেড়ে দেখে সরিয়ে আরেকটি আকারে ছোট বইয়ের দিকে মনযোগ দিলেন। বইটি ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের। সে বইটির দাম পরিশোধ করে তিনি পরের স্টলের দিকে পা বাড়ালেন। কিছুদিন আগে সামাজিক অনুষ্ঠানে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন, বইপড়ার তো সময় পাই না। আবুল মাল আবুল মুহিতের মুখে এ কথা কল্পনাই করা যায় না। তিনি ব্যতিক্রম ও উজ্জ্বল ছিলেন। পরবর্তীকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছে তার দু-চারটি পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা কাজে সম্পৃক্ত হবার।
তার ৮৫তম জন্মদিন উৎসব হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সম্ভবত ঢাকায় জন্মদিনের এটাই শেষ কোনো উন্মুক্ত আয়োজন। তারপর করোনা আক্রান্ত পৃথিবী। সময় প্রকাশনীর আয়োজনে জন্মদিন উদযাপন ও নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জান স্যার বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মুক্তিযুদ্ধের পর নৈতিক জায়গা থেকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে মন বদলান।’ বঙ্গবন্ধুকন্যার ইচ্ছাকেও গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়েছেন সবসময়।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তিনি মননশীল, জাগ্রত ও সতর্ক এক মানুষ। তার জীবন ও কর্মস্পৃহা ঈর্ষণীয়, অফুরান।’
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তিনি স্পষ্টবাদী মানুষ। স্পষ্টবাদীতার জন্য তিনি নানা সময় বেকায়দায় পড়েছেন কিন্তু তার প্রজ্ঞা দিয়ে পরিস্থিতি উতরে গেছেন।’
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছিলেন, ‘তিনি সৌভাগ্যের বরপুত্র। আমি তাকে একজন গবেষক হিসেবেই বেশি গুরুত্ব দিই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হতো।’
লেখক ও রাজনীতিক নূহ-উল আলম লেলিন অর্থমন্ত্রীর প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
আর যাকে ঘিরে এ আয়োজন তিনি নিজে বলেছেন, ‘জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। অতৃপ্তি নেই। ষোল আনা তৃপ্তি নিয়ে যাপন করছি এ জীবন।’
শুধু অর্থনীতির বিকাশ নয়, এদেশের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিকাশে তার বিশেষ আগ্রহ ও ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। স্পষ্টবাদী এক সফল মানুষ ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। ৮৮ বছর বয়সে তার শারীরিক প্রস্থান হলো। সিলেটবাসী তার প্রিয় সন্তানকে ও দেশবাসী এক কীর্তিমানকে হারাল। কিন্তু তার কর্মে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’
লেখক: কবি ও গবেষক
এসএন