কার্যকর সিটি করপোরেশনের প্রত্যাশায়
বাংলাদেশে পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন নিয়ে নগর স্থানীয় সরকার গঠিত। নগর স্থানীয় সরকার আইনসভার মতো কাজ করে। এটি সিটি করপোরেশনের সাধারণ নীতি এবং কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করে এবং বিতর্ক করে, শহুরে স্থানীয় সংস্থার বাজেট পাস করে, কর, সম্পদ বৃদ্ধি, পরিষেবার মূল্য নির্ধারণ এবং পৌর প্রশাসনের অন্যান্য দিকগুলির সাথে সম্পর্কিত বিস্তৃত নীতি তৈরি করে। নগর পরিকল্পনা শহুরে স্থানীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেখানে কর্তৃপক্ষকে জনগনের মৌলিক অবকাঠামো পরিষেবা (পরিবহন, জল এবং স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বিনোদন) নিশ্চিত করতে হয়।
সিটি করপোরেশন বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হচ্ছে এবং সিটি করপোরেশনকে কার্যকর করার জন্য কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করা যায় সে সম্পর্কে আমি এই লেখায় সংক্ষেপে আলোচনা করব। উদ্বেগের বিষয় হল কেন্দ্রীয় প্রশাসন সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয় (মেয়র সহ) কিন্তু এর কার্যাবলী একটি সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এবং যারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না বলে ধারণা করা হয়। প্রতিনিধিত্ব ও তার মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতি নজর দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। শহর পর্যায়ে ভূমিহীনদের নাগরিকত্ব না থাকায় গ্রামীণ অভিবাসীদের বিশাল জনসমষ্টির স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার নেই। বাস্তবতা বলছে, একটি সিটি করপোরেশন স্বাধীনভাবে তার কর্ম পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারে এমন লক্ষণ খুব কম। দুর্ভাগ্যবশত, এই শহুরে স্থানীয় সংস্থাগুলি তাদের অর্গানোগ্রামের অনুমোদনসহ অনেক বিষয়ে আর্থিক সহায়তা এবং প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলি তাদের হার, কর, ফি বা এমনকি ছোট চার্জ সংশোধন করতে পারে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের ছাড়পত্র ছাড়া।
স্থানীয় মধ্যস্থতাকারীরা সক্রিয়ভাবে বস্তিবাসীদের এনজিও থেকে সুবিধা নিতে নিরুৎসাহিত করে এবং ফলস্বরূপ এনজিওগুলিকে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এই স্থানীয় মধ্যস্থতাকারী নেটওয়ার্কগুলির সাথে মধ্যস্থতা করতে হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রথমত, স্থানীয় জনগণকে মৌলিক সেবা প্রদানের জন্য দায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে জনবলের ঘাটতি রয়েছে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পরিষেবা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন যা তাদের দায়িত্ব। আবার আর্থিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাজেট বরাদ্দের প্রক্রিয়াটি আনাড়ি এবং ধীর। প্রতিষ্ঠানগুলোরসিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে । বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু ওভারল্যাপিং ফাংশন রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, ডিসিসি এবং ঢাকা ওয়াসা উভয়ই ঢাকা মহানগরে পানি সরবরাহ করে।
দেশে বর্তমানে ১২টি সিটি করপোরেশন ছাড়াও ৩৩০টি পৌরসভা রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয় ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান এবং ব্লক বরাদ্দের উপর নির্ভরশীল। সম্পদের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি করদাতাদের প্রতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের ফলে টেকসইযোগ্যতা অর্জনের প্রচেষ্টা অদৃশ্য বলে মনে হচ্ছে। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বল মনিটরিং, পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য আইন ভঙ্গ করে হলেও কাউন্সিলররা কর বৃদ্ধি বা নতুন কর আরোপকে সমর্থন করতে নারাজ। এভাবে ক্রমবর্ধমান শহুরে জনসংখ্যার চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সরকারকে রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখীন হতে হয়।
সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের জন্য এর কমিটিগুলোর কার্যকারিতা সহায়ক ভূমিকা পালন পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্থায়ী কমিটি সদস্যদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ রয়েছে, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কমিটির সভাগুলি সহযোগিতা এবং সমস্যা সমাধানের একটি ফোরাম হিসাবে কাজ করে। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়মিতভাবে আয়োজন করতে হবে যাতে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
সর্বোপরি সিটি করপোরেশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চেতনা সমুন্নত রাখতে কমিটিকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। জনসেবার পরিমাণগত ও গুণগত উন্নতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে কোনও বিড়ম্বনা ছাড়াই সেসব সেবা-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া উচিত। ভূমি-ব্যবহার এবং ভবন নির্মাণের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নগর পরিকল্পনার উপর জোর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। গার্হস্থ্য, শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে জল সরবরাহ ত্বরান্বিত করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে যেন সিটি করপোরেশনে বসবাসকারী নাগরিকরা সময়মতো সর্বোত্তম পরিষেবা পায়। এক্ষেত্রে কর্মদক্ষতাকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার অবশ্যই তার নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধ। তাদেরকে সততার সাথে জনস্বার্থ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত। নির্বাচনী সংস্কারের মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকারে সিটিজেন চার্টার/ নাগরিক সনদ ও সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যাহারের ব্যবস্থার মতো আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।
মেয়রের পর্যালোচনায় কর মওকুফের সংস্কৃতি বন্ধ করা এবং বর্তমানে প্রচলিত ব্লক বরাদ্দের পরিবর্তে কার্যক্ষমতাভিত্তিক অনুদান ব্যবস্থা কার্যকর করা উচিত।একটি অভিযোগ প্রতিকার কমিটি এবং স্টেকহোল্ডারদের দ্বারা প্রতিনিধিত্বে গঠিত একটি সমন্বয় কমিটি থাকা উচিত যাতে সোচ্চার হওয়া এবং জবাবদিহিতার একটি পদক্ষেপ হিসাবে কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করা যায়। সু-নগর শাসনের জন্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকর নেতৃত্বের সাথে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের, স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত, এনজিও, সুশীল সমাজ এবং জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
সিটি করপোরেশনের পরিষেবা প্রদানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা ও এর মাধ্যমে সমন্বয়ের ব্যর্থতা হ্রাস এবং স্থানীয় পরিষেবাসমূহকে উন্নত করা প্রয়োজন। এই স্তরে স্থানীয় জবাবদিহিতা এবং উন্নত কর্মক্ষমতা, উভয়ের অগ্রগতিকেই উৎসাহ দেয়া দরকার। দারিদ্র্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গড়ে তোলা আবশ্যক।
লেখক: ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিজিটিং স্কলার (অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ)। ইমেইল: t.islam@juniv.edu