বেদনার কথা বলবো কোথায়?
ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সাথে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ, নিহত একজন, আহত শতাধিক। সংঘর্ষ চলেছে রাতভর পরবর্তী দিনেও দফায় দফায় হয়েছে সংঘর্ষ। পুলিশ কতখানি দায়িত্ব পালন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নেতারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখেন, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত তারপরও কেন সংঘর্ষ থামানো গেল না? এই প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, ঠিক এই কারনেই সংঘর্ষ থামাতে এত দেরি হলো এবং সম্ভবত এ কারনেই পুলিশ ভুমিকা পালন করতে দ্বিধা বা দেরি করেছে। এ নিয়ে পাল্টা পালটি বক্তব্য হবে অনেক। কিন্তু ছাত্রদের দিকে তেড়ে আসছে মার্কেটের কর্মচারীরা, গুলি করছে, টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে, লাঠি পেটা করছে পুলিশ। ছাত্ররা কি তাহলে সবার প্রতিপক্ষ হয়ে গেল? সবার এত রাগ, ঘৃণা ছাত্রদের প্রতি তৈরি হয়ে গেলো কিভাবে? মানুষের ভরসা ও ভবিষ্যৎ যে ছাত্ররা, সেটা পরিবারে বা সমাজে সবখানেই তাঁরা কেন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে এই অপবাদের বোঝা কাঁধে নিল?
পত্রিকায় এসেছে দুজন কর্মচারী নিজেদের মধ্যে দোকান বসানো, দোকান সাজানো নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের একজন আর একজনকে দেখে নেবে বলে কলেজের ছাত্রদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা। কোন স্তরের নেতা তা স্পষ্ট না হলেও ক্ষমতাসীন দলের সিল থাকলে সবার ক্ষমতার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল তো শুধু ছাত্রদের মধ্যে নয়, ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তো আছে। তারাও বা ক্ষমতা দেখাবেন না কেন? ক্ষমতা দেখানোর এই প্রতিযোগিতায় বলি হলো সাধারণ পথচারি আর ধুলিস্যাত হলো সাধারণ ছাত্রদের ভাবমূর্তি।
ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এত ঐতিহ্য, এত সুনাম চাপিয়ে কিছুদিন পর পর মার্কেটে চাঁদাবাজির ঘটনার সাথে জড়িয়ে যায় তাদের নাম। কিন্তু কেন এমন হলো, কেন এমন হচ্ছে? ক্ষমতার স্বাদ পেলে কেন ছাত্রদের মধ্যে চাঁদাবাজি নামক এই দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমণ হয়? ঈদের আগে প্রায় প্রতিবার কোন না কোন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের ছাত্রদের সাথে গাউছিয়া, চন্দ্রিমা, নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর কারণ প্রায় সবাই জানলেও দূর করার উদ্যোগ তো দেখা যায় না।
একথা প্রায় সকলেই বলে থাকেন, আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে অথচ শিক্ষার মান বাড়ছে না। তাহলে এত নামী দামী প্রতিষ্ঠানগুলো কি করে? সেখানে কি কিছু গৎবাঁধা বিষয় সেখানো হয়? সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোন চর্চার পরিবেশ কি আছে? শিক্ষক হচ্ছেন তিনি যিনি শিখা দিয়ে শিখা জ্বালানোর কাজ করেন, শুধু তোতা পাখির মত মুখস্ত করা নয় প্রশ্নের খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন মনটাকে আর স্বপ্নের বীজ বপন করে ভবিষ্যতের ফলের সম্ভাবনা তৈরি করেন। তিনি অতীতের অভিজ্ঞতার সার সংকলনের সাথে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংযোগ সাধন করিয়ে তাঁকে প্রস্তুত করেন ভবিষ্যতের জন্য। এসবের জন্যই দরকার তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকে, ক্ষমতাসীনদের দাপটে ছাত্ররা জীবনের ভয়ে সংকুচিত থাকে বা সম্মান হারানোর ভয়ে ম্রিয়মাণ থাকে তাহলে পাঠ্যপুস্তক পড়ে পুঁথিগত বিদ্যালাভ হয়তো করতে পারে কিন্তু জ্ঞান ও মর্যাদা সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি হবে না।
শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? তথ্য এবং জ্ঞানের পার্থক্য কি? যা যাচাই করা যাবে না তা নিয়ে তর্ক করা কি যাবে? দীর্ঘদিন ধরে যা জেনে এসেছি তার সঙ্গে নতুন জ্ঞানের বিরোধ হলে করণীয় কি? নতুন কিছু হলেই কি তা গ্রহণ করতে হবে নাকি পরীক্ষায় প্রমাণিত হলে গ্রহণ করা যাবে? পরিবর্তনশীল প্রকৃতিজগতকে জানার উপায় কি বিজ্ঞান না অতীত থেকে পাওয়া বিশ্বাস? এমনি অনেক প্রশ্নের উত্তর মানুষ পাবে কিভাবে এবং কোথা থেকে? পাঠ্যপুস্তকের পাতায় এসবে উত্তর পাওয়া যাবে না। এসব পেতে হবে ছাত্র আন্দোলনে, রাজনৈতিক সংগ্রামে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ঢাকা কলেজ সহ সব নাম করা এবং বড় কলেজগুলোতে কি সে পরিবেশ এখন আছে? অনেকেই আহাজারি করছেন কি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ যারা পথ দেখিয়েছে শিক্ষা অধিকার আন্দোলনে, আজ তার নাম জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায়।
নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চন্দ্রিমা সহ এই এলাকার মার্কেটের ক্রেতা কারা? মধ্যবিত্তের নিচের অংশ যারা দরদাম করে জিনিস কেনেন, ছাত্র ছাত্রীদের বিরাট অংশ যারা একটু কম দামে জিনিস পাবার জন্য দোকানে দোকানে জিনিস যাচাই করে, দাম নিয়ে দরকষাকষি করে। সেখানে বিক্রেতাদের আচরণ এবং ব্যবহার যে কতটা অপমান ও তাচ্ছিল্যের সে কথাও উল্লেখ করেন অনেক ভুক্তভোগী। এইসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও কি তার জন্য দায় নেবেন না? একজন নারী ক্রেতা লিখেছেন, তিনি প্যান্ট কেনার জন দরদাম করছিলেন, তাঁকে এক পর্যায়ে বলা হলো এই দামে প্যান্ট পাবেন না, প্যান্টি কিনে নিয়ে যান। তার লজ্জার সাথে অপমান যুক্ত হলো যখন তিনি দেখলেন পাশের দোকানের বিক্রেতারাও দাঁত বের করে হাসছেন।
ছাত্রদের চাঁদাবাজ আর বিক্রেতাকে বেয়াদব বলার আগে কি ভাববেন না কেন এবং কারা এসবের সাথে যুক্ত? গড়ে সবাইকে দায়ী করে সমস্যার সমাধান মিলবে না বরং শত্রুতা স্থায়ী হবে। সমাজে গণতন্ত্র না থাকলে, জবাবদিহিতা না থাকলে, অপরাধ করেও ক্ষমতার সাথে থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না এই মনোভাব থাকলে শুধু ভোটের অধিকার নয় সকল ক্ষেত্রেই যে ধ্বস নামে তা উপলব্ধি করার সময় কি এখনও আসেনি?