যানজট-দূষণ-দাবদাহে রাজধানীবাসীর মরণদশা
‘এবারের ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবেন। ...যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় নারকীয় পরিস্থিতি হতে পারে। ...আগামী ২৫ রমজান থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যাবে।’ (বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলন, সমকাল, ১৮ এপ্রিল)
এতে শুধু ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর যানজটের ভয়াবহ অবস্থার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এমনিতে ছুটির দিন শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিনেও রাজধানীর যানজটের অবস্থা কম ভয়াবহ নয়। প্রতিদিন রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। দুঃসহ গরমে যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়। আর যারা এসি গাড়িতে যায়, তারাও বিরক্তি ও অস্বস্থিতে ভোগেন। দুপুরের দিকে যানজট কিছুটা সহনীয় হলেও সকাল থেকে রাত অবধি তা চলমান থাকে। সভা-সমাবেশ, সংঘর্ষ বা কোনো কারণে কোনো সড়ক বন্ধ হয়ে গেলে তার চাপ পড়ে গোটা রাজধানীতে। এতে স্থবির হয়ে যায় পুরো নগরী।
শুধু কি যানজট? শব্দ দূষণের কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষ নানা রোগব্যাধির শিকার হচ্ছেন। “‘শব্দ দূষণে উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসার, বিরক্তি সৃষ্টি হয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন শিশু এবং বয়স্করা৷ এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়, অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়৷ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান ডা. মনি লাল আইচ লিটু বলেন, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে এইভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে৷’” (ডয়েচে ভেলে, ২১ জানুয়ার ২০১৮)
এটি ২০১৮ সালের গবেষণার তথ্য। এখন ২০২২ সাল। তাই এ সময়ে এ রকম আরেকটি গবেষণারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তবে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকা শব্দ দূষণে বিশ্বে চ্যাম্পিয়িন হয়েছে!
“‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দ দূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রথম। দ্বিতীয় স্থানে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল। আর ১০৩ ডেসিবল মাত্রার শব্দ হয়ে থাকে রাজশাহীতে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। এ ছাড়া ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ আছে।” (ডেইলি স্টার বাংলা অনলাইন ২৭ মার্চ, ২০২২)
বায়ু দূষণেও বিশ্বে রাজধানী ঢাকা সবার চেয়ে এগিয়ে। “বায়ুদূষণে টানা চতুর্থবারের মতো ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকার শীর্ষে নাম উঠেছে বাংলাদেশের। বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুমানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে একটি দেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমান বজায় রাখতে পারেনি; আর দূষণের মাত্রার বিচারে সবার ওপরে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।” (ইত্তেফাক, ২২ মার্চ ২০২২)
জনসংখ্যার চাপ এবং নানা শিল্প কারখানা, ভবন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামতের কারণে বছরজুড়ে চলে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে ধূলোয়, বাতাসে ভাসে নানা বিষাক্ত কণা। যা প্রতি নিঃশ্বাসে আপনার-আমার শরীরে ঢুকছে! এতে নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীবাসী।
দেশের বাইরে থেকে আসা দূষিত বাতাসও রাজধানীর বায়ু দূষণ করছে। ‘পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, সীমান্তের বাইরে থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন বস্তুকণা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে উড়ে আসার কারণে ঢাকার বায়ু আরও বেশি দূষিত হয়ে পড়ছে। গবেষকরা বলছেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব অতি সূক্ষ্ম পদার্থ।’ (বিবিসি বাংলা, ২৬ জানুয়ারি ২০২২)
বায়ু দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ুও কমে যাচ্ছে। “শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ এর গবেষণায় আরও দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় গত ১০ বছরে বায়ু দূষণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। ...বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।” (ইত্তেফাক, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১)
দেখা যাচ্ছে, সব ধরনের দূষণে রাজধানী ঢাকা এগিয়ে! বাকি থাকল কী? রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, টঙ্গী খাল দখলে-দূষণে ইতিমধ্যে মৃতপ্রায়। দুর্গন্ধ, দূষিত কালো পানিতে এই নদীগুলোতে মাছসহ জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা দুষ্কর।
“প্রায় দুই কোটি নাগরিকের এই ঢাকা এখন একটি পয়োবর্জ্যে বিপর্যস্ত নগরী। এই বিপর্যয়ের মূল কারণ, নগরীতে পর্যাপ্ত সু্য়ারেজ লাইন নির্মাণে ঢাকা ওয়াসার অমার্জনীয় ব্যর্থতা। ঢাকা মহানগরী এবং এর আশপাশের শিল্পকারখানাগুলো থেকে অব্যাহতভাবে নদীগুলোতে নানাবিধ কৌশলে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হয়। জৈব-অজৈব বর্জ্যের কারণে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এমনকি শীতলক্ষ্যা, বংশী, লবণদহ, খীরো নদীও আজ দূষণের কারণে ‘ইকোলজিক্যালি ডেড’-এ পরিণত হয়েছে।” (ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল ২০২২)
এসব কারণে রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর আগামী কয়েক বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। গবেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী–এই চারটি জেলা শহরে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, ফলে সবসময় গরম অনুভূত হবে।
“...গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের চট্টগ্রামের তাপমাত্রা রাজধানী ঢাকার রাতের তাপমাত্রার চেয়েও বেড়েছে। এজন্য বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাতের বেলায় বঙ্গোপসাগর থেকে যে বায়ু চট্টগ্রামের শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায়, সেটি ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। ফলে রাতে এই শহরের তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। কানাডার ক্যালগfরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের গবেষকরাও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।” (বিবিসি বাংলা, ১ জুন ২০২১)
দূষণের সার্বিক এই চিত্র ভয়াবহ। শিউরে উঠতে হয়। রাজধানীতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেখানে যানজট নিরসন, শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বুড়িগঙ্গাসহ ৪ নদীকে বাঁচানোর জন্য সমন্বিত কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি না জানা নেই। যদি না থাকে তাহলে এসব বিষয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া এবং দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তাহলেই বাঁচবে ঢাকা। রাজধানীবাসী সুযোগ পাবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার! একইভাবে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী মহানগরীকে নিয়েও নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
এসএ/